সামনেই মুখোমুখি দেখা মেহেদি নেসারের সঙ্গে। পাশে ডিহিদার রেজা আলি।
বললে–কী খবর জনাব, মুখ এত গভীর কেন?
মিরন বললে–আর ভাইসাহেব, ফিরিঙ্গিবাচ্চা বড় মুশকিলে ফেলেছে, বলে মরিয়ম বেগমসাহেবাকে হুজুরে হাজির করতে! এখন মরিয়ম বেগমসাহেবাকে পাব কোথায়? বানাব? সে তো জাহাঙ্গিরাবাদের পথে।
সত্যই ভাবনার কথা। মেহেদি নেসার সাহেবও মাথা ঘামাতে বসল। এতক্ষণ ধরে ফিরিঙ্গিবাচ্চা আবদার ধরেছে, ও কি সহজে ছাড়বে!
মিরন বললে–এখন কী করা যায় বলো তো ভাইসাহেব, কর্তা খুব নারাজ হয়েছে আমার ওপর, খুব গালাগালি দিলে আমাকে–
ডিহিদার রেজা আলিও কিছু রাস্তা বাতলাতে পারলে না। বললে–বড়ি মুসিবত হল তো
মেহেদি নেসার বললে–সাহেব যখন একবার আবদার ধরেছে, তখন তো আর সহজে রেহাই দেবে না। ও মরিয়ম বেগমকে আদায় করে ছাড়বেই–
ওদিকে মিরদাউদ সাহেব আসছিল। সঙ্গে মিরকাশিম সাহেব। তারাও সব শুনলে। সত্যিই বড় মুসিবত কি বাত! ফিরিঙ্গিবাচ্চা তো একলা নয়, তার সঙ্গে তার আমির-ওমরা এসেছে। সঙ্গে সেপাই-বরকন্দাজ এসেছে।
হঠাৎ মিরদাউদের মাথায় একটা বুদ্ধি এল।
বললে–জনাব, আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে
সবাই আশান্বিত হয়ে উঠল–ক্যা মতলব, ক্যা মতলব?
মিরদাউদ বললে–এক কাজ করো জনাব, নফরগঞ্জ থেকে যে আওরতকে ধরে এনেছি, তাকে ফিরিঙ্গিবাচ্চার কাছে হাজির করে দাও,বলল গিয়ে–এরই নাম মরিয়ম বেগমসাহেবা-সাহেব ঠাহর করতে পারবেনা।
বুদ্ধিটা সকলের বড় পছন্দ হল।
মেহেদি নেসার সাহেব বললে–খুব আচ্ছা মতলব!
ডিহিদার রেজা আলিও বললে–বহোত আচ্ছা মতলব
সেদিন সবাই একবাক্যে স্বীকার করলে এমন নিখুঁত মতলব আর হয় না। ক্লাইভ সাহেব নিজের মহলে গিয়ে তখন অপেক্ষা করছে। দেরি করলে আবার সাহেব গোঁসা করবে। আবার মিরজাফর সাহেবের কাছে গিয়ে তাগিদ দেবে। তখন আবার গালাগালি খেতে হবে মিরজাফর সাহেবের কাছ থেকে। আর দেরি করে ফয়দা নেই
কিন্তু মিরন সাহেবের বাড়িতে গিয়ে বজ্রাঘাত হল সকলের মাথায়। বাড়ির পেছন দিকে সার সার। ঘর। সেখানে নেয়ামতকে ভার দিয়ে রেখেছিল মিরন। মতিঝিলের খিদমদগার নেয়ামতই বলতে গেলে তদারক করছিল সকলের। তার কাছেই ছিল ঘরগুলোর চাবি। নেয়ামত ছাড়া যেসব সেপাই ছিল, তারাও তখন সেখানে কেউ নেই। মহলটা খাঁখাঁ করছে। ঘরগুলোর চাবি খোলা।
বাঁদিরা কোথায় গেল?
মিরন ঘরটার ভেতরে উঁকি দিয়ে ভাল করে দেখলে কোথায় গেল বাঁদিরা!
পাশের ঘরেও তাই। ঘরটা খাঁখাঁ করছে। মিরন তাড়াতাড়ি পাশের ঘরটার ভেতরে ঢুকল। নবাব মির্জা মহম্মদও এই ঘরেই ছিল।
ইয়া আল্লাহ
অন্ধকারের মধ্যে হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় নবাব তখন চুপ করে বসে আছে। হয়তো পালিয়েই যেত। কিন্তু শেষপর্যন্ত ঠিক সময়ে মিরন এসে পড়াতে পালাতে পারেনি।
সামনে মিরনকে দেখেই মুখ তুলেছে নবাব। চোখে-মুখে কৌতূহল।–কে? কে তোমরা?
মিরন আর কথার উত্তর দিলে না। তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।
মিরদাউদ জিজ্ঞেস করলেনবাব আছে অন্দরে?
মিরন বললো জনাব, খোদা বাঁচিয়ে দিয়েছে, নেয়ামতকে ভার দিয়ে গিয়েছিলুম, সে বেটা বেইমানি করে পালিয়েছে। এবার বেটাকে আস্ত কোতল করব–
ভাগ্যিস লুৎফুন্নিসা বেগমসাহেবাকে আগে থেকে সরিয়ে ফেলেছিলুম জনাব, নইলে সে-ও ভেগে যেত
মিরনের সত্যিই তখন আর সময় নেই। এখনই ক্লাইভ সাহেবের ডাক পড়তে পারে। ভেতর থেকে বাড়ির ফটকের পাহারাদারকে ডাকলে।
বললে–মহম্মদি বেগ, নেয়ামত কোথায়?
বেগ বললে–নেয়ামত তো আমাকে কিছু বলে যায়নি হুজুর?
ঘরের চাবি তোর কাছে দিয়ে গেছে?
নেহি হুজুর!
তা হলে নতুন একটা তালা-চাবি জোগাড় করে আন।
তারপর সেই তালা-চাবি এল। নতুন করে আবার মির্জা মহম্মদের দরজায় তালা-চাবি পড়ল। যারা ভেঙ্গেছে, তারা ভাগুক, কিন্তু নবাব যেন না পালায়, দেখিস। খুব হুঁশিয়ার। নবাব ভাগলে সব উলটে যাবে। মিরজাফর সাহেবের নবাব হওয়া ঘুচে যাবে।
তারপর আর সেখানে দাঁড়ালু না মিরন। মিরদাউদ, মিরকাশিম, মেহেদি নেসার, রেজা আলি সবাই পড়ে রইল সেখানে। তাড়াতাড়ি মতিঝিলের ঘাট থেকে আর একটা বজরা নিলে। খুব দেরি হয়ে গেছে।
ওদিকে অনেক দূরে ছ’টা বজরা তখন ভগবানগোলার দিকে ভেসে ভেসে চলেছে। সবচেয়ে পেছনের বজরায় একজন বেগম বোরখা পরে আছে। তার জীবনের চারপাশেও তখন বুঝি বোরখার আড়াল নেমেছে। কোনও দিকেই খেয়াল নেই তার। শুধু একমনে অদৃশ্য দেবতার কছে সে প্রার্থনা করে চলেছে, তুমি তাকে সুখী করো ঈশ্বর। সে যেন মুর্শিদাবাদের পাপ আর পঙ্কিলতা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে গিয়ে সে যেন শান্তি পায়। যেন সুখ পায়, সংসার পায়, স্বামী পায়, সন্তান পায়।
বজরাগুলো সার সার ভেসে চলেছে জোয়ারের স্রোতে। ভাটার পর জোয়ার এসেছে। আবার ভাটা আসবে, আবার জোয়ার। জোয়ার-ভাটার টানাপোড়েনে বাঁধা আমাদের জীবন। ইতিহাসেরও বুঝি জোয়ার-ভাটা আছে। সেই জোয়ার-ভাটার টানাপোড়েনে রাজ্য ওঠে, রাজ্য পড়ে, মসনদ একবার খালি হয়, আবার ভরে। শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে যায় এমনি করে। জন্ম থেকে যে-জীবন শুরু হয়, মৃত্যুতেই তার পূর্ণচ্ছেদ পড়ে। কিন্তু মানুষের পৃথিবীর বুঝি মৃত্যু নেই। তাই আবার জন্ম হয়, তারপর আবার মৃত্যু আসে। জন্ম-জন্মান্তরের জীবন তাই অশেষ। শেষের দিকেই তার গতি, কিন্তু সে অশেষযাত্রা। সেই অশেষযাত্রার যে পথিক, তার মনে শঙ্কা নেই, তার মনে বিকার নেই, তার মনে অনুতাপ নেই।