বিশেষ কিছু ঠিক হইল না। তাহার মায়ের তখনও খাওয়া হয় নাই। স্নান সারিয়া পুনরায় রান্নাবাড়ি চলিয়া গেল। অপুর একটা কথা মনে হইল। তাহার গানের গলা আছে, দিদি বলিত, যাত্ৰাদলের বন্ধুও সেবার বলিয়াছিল। সে যদি কোনো যাত্ৰাদলে যায়, তাহাকে নেয় না? এখানে মা’র বড় কষ্ট। এখান হইতে সে মাকে লইয়া যাইবে!
উঃ কি গরম! রান্নাবাড়ির নলের মুখে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাইয়া উঠিতেছে, কার্নিসের গায়ে রোদ, ঘরের ভিতরটা এরই মধ্যে অন্ধকার, আস্তাবলে মাতাবিয়া সহিস কি হিন্দি বুলি বলিতেছে. পাথর-বাঁধানো মেজেতে ঘোড়ার খুর ঠুকিবার খট্ খট্ আওয়াজ, ড্রেনের সেই গন্ধ… তাহার মাথাটা এমন ধরিয়াছে যেন ছিঁড়িয়া পড়িতেছে। সে ভাবিল … এখন একটু শুয়ে নিই, এরপর উঠে খেলার মাঠে যাবো–মোটে তিনটে বেজেছে-এখন বড় রোদটা।
বিছানায় শুইয়া একটা কথাই বার বার তাহার মনে আসিতে লাগিল। এ কথাটা এতদিন এভাবে সে ভাবিয়া দেখে নাই। এতদিন যেন তাহার মনের কোন কোণে সব সময়ই স্পষ্টভাবে জাগিয়া থাকিত যে, এ সবের শেষে যেন তাহদের গ্রাম অপেক্ষা করিয়া আছে–তাহদের জন্য! যদিও সেখান হইতে চলিয়া আসিবার সময় ফিরিবার কোনো কথাই ছিল না-সে জানে, তবুও এ মোহটুকু তার একেবারে কাটে নাই।
কিন্তু আজকার সমুদয় ব্যাপারে বিশেষ করিয়া মাযেব ও বড়বাবুব কথায় তাহাদের নিরাশ্রয়তা ও গৃহহীনতার দিকটা তাহার কাছে বেশ স্পষ্ট হইয়া উঠিল। আর কি কখনও সে তাহাদের গায়ে ফিরিতে পাইবে না?–কখনও না?–কখনও না?
এই বিদেশ, এই গিরিশ সরকার, এই চোর হইয়া থাকা-না হয় মায়ে ছেলে হাত ধরিয়া ছন্নছাড়া পথে পথে চিরকাল-এরাই কি কায়েম হইতে আসিয়াছে?
আস্তাবলে দুই সহিসে বাগড়া বাধাইয়াছে, রান্নাবাড়ির ছাদে কাকের দল ভাতের লোভে দলে দলে জুটিতেছে-একটু পরে তাহার মনে হইল, একই কি কথা অনেকক্ষণ ধরিয়া ভাবিতেছে, একই কি কথা। আস্তাবলে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ থামে নাই.. সে যেন মাটির ভিতর কোথায় সেঁধিয়া যাইতেছে… খুব, খুব মাটির ভিতর. নিচের দিকে কে যেন টানিতেছে… বেশ আরাম…মাথা ধরা নাই, বেশ আরাম…
উঃ—কি রোদটাই ঝাঁ-ঝাঁ করিতেছে! দিদির যা কাণ্ড—এত রোদ্দুরে চড়ুইভাতি! সে বলিতেছে—দিদি শুয়ে নে, এত রোদ্দুরে চড়ুইভাতি?
রানুদি কানের কাছে বসিয়া কি সব কথা, অনেক কি সব কথা বলিয়া যাইতেছে। রানুদির ছলছল ডাগর চোখ দুটি অভিমান-ভরা! সে কি করিবে? নিশ্চিন্দিপুরে তাদের চলে না যে? রানুদি না লীলা?
হারান কাকা বাঁশের বাঁশি বেচিবার জন্য আনিয়া বাজাইতেছে…ভারি চমৎকার বাজায়! সে বাবাকে বলিল—এক পয়সার বাঁশের বাঁশি কিনবো বাবা, একটা পয়সা দেবে?…
তাহার বাবা তাহার বড় বড় চুল কানের পাশে তুলিয়া দিতে দিতে আদর করিয়া বলিতেছে–বেশ হয়েচে তোর গল্পটা, ছাপিয়ে এলে আমায় দেখতে দিস খোকা?
সে বলিতেছে-কোকেন কি বাবা? গিরিশ সরকার বলেচে। আমি নাকি কোকেন খাবো—
বাবার গলায় পদ্মবীজের মালা। সেই কথকঠাকুরের মতো।
তাহদের মাঝেরপাড়ার ইস্টিশন। কাঠের বড় তক্তাটায় লেখা আছে, মা-ঝে-র-পা-ড়া। সে আগে আগে ভারী বোঁচকাটা পিঠে, মা পিছনে পিছনে। তাহার গায়ে রাঙা পাঞ্জাবিটা। কেমন ছায়া সারাপথে। আকাশে সন্ধ্যাতারা উঠিয়াছে। পাকা বটফলের গন্ধে-ভরা বাতাসটা।
নিশ্চিন্দিপুরের পথ যেন ফুরাইতেছে না…সে চলিয়াছে…চলিয়াছে..চলিয়াছে…সে আর মা…এ পথে একা কখনও আসে নাই, পথ সে চিনিতে পারিতেছে না…ও কাস্তে হাতে কাকা, শুনচো, নিশ্চিন্দিপুরের পথটা এটু বলে দ্যাও না আমাদের? যশড়া-নিশ্চিন্দিপুর, বেত্ৰবতীর ওপারে?
তাহার মা ঘরে ঢুকিয়া বলিল-হ্যাঁরে ওঠ, ও অপু, বেলা যে আর নেই, বললি যে কোথায় খেলতে যাবি?-ওঠ-ওঠ।
সে মায়ের ডাকে ধড়মড় করিয়া বিছানার উপর উঠিয়া বসিয়া চারিদিকে চাহিল-উঃ কি বেলাই গিয়াছো… রোদ একেবারে কোথায় উঠিয়া গিয়াছে? তাহার মা বলিল-বললি যে কোথায় খেলতে যাবি, তা গেলি কই? অবেলায় পড়ে পড়ে কি ঘুমটাই দিলি? দেবো তোর সেই বাঁশিটা বের করে?
তোরঙ্গ হইতে বাহির করিয়া বাঁশিটিা মা বিছানার কোণে রাখিয়া দিল বটে, সে কিন্তু রেফারিগিরি করিতে যাওয়ার কোনো উৎসাহ দেখাইল না। ঘরের ভিতর এরই মধ্যে অন্ধকার! উঠিয়া আসিয়া জানালার কাছে অন্যমনস্কভাবে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া রহিল। বেলা একেবারে নাই। এক অসহ্য গুমোট! আস্তাবলের ড্রেনের গন্ধটা যেন আরও বাড়িয়াছে। ফটকের পেটাঘাঁড়িতে ঠং ঠাং করিয়া বোধ হয় ছটা বাজাইতেছে।
ওই আস্তাবলের মাথাব্য যে আকাশটা, ওরই ওপারে পূর্বদিকে বহুদূরে তাঁহাদের নিশ্চিন্দিপুর।
আজ কতদিন সে নিশ্চিন্দিপুর দেখে নাই-তি-ন বৎসর! কতকাল!
সে জানে নিশ্চিন্দিপুর তাহাকে দিন রাতে সব সময় ডাকে, শাঁখারিপুকুর ডাক দেয়, বাঁশবনটা ডাক দেয়, সোনাডাঙার মাঠ ডাক দেয়, কদমতলার সায়েবের ঘাট ডাক দেয়, দেবী বিশালাক্ষী ডাক দেয়।
পোড়ো ভিটার মিষ্ট লেবু ফুলের গন্ধে সজনেতলার ছায়ায় ছায়ায় আবার কবে গতিবিধি? আবার কবে তাহদের বাড়ির ধারের শিরীষ সৌদালি বনে পাখির ডাক?
এতদিনে তাহদের সেখানে ইছামতীতে বর্ষার ঢল নামিয়াছে। ঘাটের পথে শিমুল তলায় জল উঠিয়াছে। ঝোপে ঝোপে নাটা-কাঁটা, বনকলমির ফুল ধরিয়াছে। বন অপরাজিতার নীল ফুলে বনের মাথা ছাওয়া।
তাহাদের গ্রামের ঘাটটাতে কুঁচ-ঝোপের পাশে রাজুকাকা হয়তো এতক্ষণে তাহার অভ্যাসমতো