সন্ন্যাসী বল্লেন–নয়তো কি ভেবেচ ইনি মায়ার অতীত হয়ে যাতায়াতের চক্রপথ এড়িয়ে ব্রহ্মত্ব লাভ করেছেন? আত্মানং বিধি আত্মাকে জানো–আত্মাকে না জানলে যাতায়াত বন্ধ হবে না–
ক্ষেমদাস বলে উঠলেন–বয়েই গেল। ক্ষতিটা কি?
-বাজে কথা বলো না কবি। তোমার ক্ষতি না হতে পারে। তোমার মত চোখ আর মন নিয়ে ক’জন পৃথিবীতে যাবে? সাধারণ লোক গিয়ে অর্থ, যশ, মান, নারী নিয়ে উন্মত্ত থাকবে। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য মায়ার খেলা হোক–তবুও স্বীকার করি, দেখতে জানলে তা দেখেও সৃষ্টিকর্তা হিরণ্যগর্ভের প্রতি মানুষের মন পৌঁছতে পারে। ও যে একটা সোপান। কিন্তু তা ক’জনের চোখ থাকে দেখবার? আর্তের সেবা করে কজন? কাজেই মানুষের দুঃখ যায় না। মনে আনন্দ পায় না; ভোগ করতে করতে একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করে জরার অধিকার শুরু হয়েছে। তখন মৃত্যুভয়ে বলির পশুর মত জড়সড় হয়ে থাকে। তা ছাড়া আছে। শোক, বিচ্ছেদ, বিত্তনাশ, অপমান, আশাভঙ্গের যন্ত্রণা। কোথায় সুখ বলো?
–দুঃখের মধ্যেই আনন্দ হে সন্ন্যাসী–দুঃখ ভোগ করতে করতেই আত্মা বড় হয়ে ওঠে, বীতস্পৃহ হয়, বীতম হয়, বীতশোক হয়। ভগবানের দিকে মন যায়। জন্মে জন্মে আত্মা বললাভ করে, জন্ম জন্মান্তরের চিয়ার আগুনে পুড়ে সে ক্রমশ নিৰ্ম্মল, শুদ্ধ, জ্ঞানী হয়ে ওঠে। ভগবানেরই এই ব্যবস্থা–এ তুমি অস্বীকার করতে পারো? ক’জন তোমার মত নর্মদাতীরে সারাজীবন তপস্যা করে ভগবানের দর্শন পেয়েছে? বহু ভুগে, বহু ঠকে, বহু নারী, সুরা, অর্থ বিত্ত ভোগ। করে মানুষ ক্রমশ বিষয়ভোগ থেকে নিবৃত্ত হয়ে আসে–বহু জন্ম ধরে এমন চলে–তখন জন্ম-জন্মান্তরীণ স্মৃতি তাকে বলে আবার কোনো নতুন জন্মে–ও থেকে নিবৃত্ত হও, ও পথ তো দেখলে গত কত শত জন্ম ধরে, আবার সেই একই ফাঁদে পড়ো, সেই রকম কষ্ট পাবে। ভোগের দ্বারা আত্মাও তখন অনেকটা বীতস্পৃহ হয়ে উঠেচে–তখন। সে ভোগ ছেড়ে ত্যাগের পথ খোঁজে।
-–হ্যাঁ, তোমার কথা কাটি কি করে? তুমি কবি, অন্য পথে গিয়ে সত্যদৃষ্টিলাভ করে। কিন্তু একটা কথা বোঝো–যদি এক জন্মেই হয়। তবে ভগবানের ওপর বোঝা চাপিয়ে শত শত জন্ম ধরে এ অনাগত চক্রে ঘোরাঘুরি কেন?..
ক্ষেমদাস সুকণ্ঠে গেয়ে উঠলেন হাত দুটি সুন্দর ভঙ্গিতে নেড়ে–
কিয়ে মানুখ জনমিয়ে পশুপাখী অথবা কীটপতঙ্গে
করমবিপাকে গতাগতি পুন-পুন মতি রহুঁ তুয়া পরসঙ্গে–
সন্ন্যাসী বিরক্তির সুরে বল্লেন–আঃ, ও সব ভাবুকতা রাখো। আমার কথার উত্তর দাও।
ক্ষেমদাস বল্লেন–কীৰ্ত্তনাদেব কৃষ্ণস্য মুক্তবন্ধঃ পরং ব্রজেৎ কলিতে বহুদোষ, কিন্তু একটা গুণ এই যে, কৃষ্ণনাম কীৰ্ত্তন করলেই পরা মুক্তি। তাই বলেচে–
এই পর্যন্ত বলেই আবার সুর করে কি বলতে যাচ্ছিলেন, সন্ন্যাসী ধমক দিয়ে বল্লেন–আবার ওই সব! গান আসচে কিসে এর মধ্যে? তা ছাড়া আমি তোমাদের ওই কৃষ্ণদৃষ্ণ মানিনে জানো? ওসব মায়িক কল্পনা–ভগবানের আবার রূপ কি!
-তুমি শুষ্ক পথে ভগবানের সঙ্গে নিজের সত্তা মিলিয়ে অদ্বৈতজ্ঞান। লাভ করে। ভক্তিপথের কিছুই জানো না। প্রেমভক্তি এখনও বাকি তোমার।
–মরুগ গে। আমার কথার উত্তর দাও
–উত্তর কি দেব? ভোগ না হোলে নিবৃত্তি হয় না। ভগবান তা জানেন, তাই শত জন্মের মধ্যে দিয়ে জীবকে তিনি ভোগ আস্বাদ করিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। সবারই হবে তবে বিলম্বে।
সন্ন্যাসী শান্ত ভাবে বল্লেন–হাঁ ঠিক।
–তুমি মেনে নিলে?
–নিলাম। কিন্তু তুমি আমার কথার ঠিক উত্তর দিলে কৈ? যদি এক জন্মে হয় তবে হাজার জন্মের মধ্যে দিয়ে দিশাহারা হয়ে ছুটি কেন?
ক্ষেমদাস হেসে বল্লেন–তার কারণ, সবাই তোমার মত মুক্তিকামী নয়, তোমার মত জ্ঞানী নয়–গত জন্মে তুমি যে উচ্চ অবস্থা নিয়ে জন্মেছিলে, যে জন্ম-জন্মান্তরীণ স্মৃতির ফলে তোমার মন মুমুক্ষ হয়েছিল, সংসারের আসক্তির বন্ধন কাটিয়েছিল–তুমিই বলো না, সে কি তুমি একজন্মে লাভ করেছিলে? তুমি তো যশ্বৈৰ্য্যশালী–মুক্ত পুরুষ–তোমার অজানা তো কিছুই নেই–বলো তুমি?
সন্ন্যাসী মৃদু হেসে বল্লেন–তা ঠিক। গত জন্মের পূর্ধ্ব তিন জন্মেও আমি যোগী ছিলাম। আমার সে সময়ের গুরুভ্রাতা এখনও হিমালয়ের দুর্গম শিখরে তুষারাবৃত গুহায় দেহধারী হয়ে বাস করচেন। প্রায় আটশো বছর বয়েস হোল। লোকালয়ের কিছুই জানেন না। গত সাতশো বছরের মধ্যে তিনবার নীচে নেমে গিয়েছিলেন ভারতের লোকালয়ে। একবার নেমে শুনলেন শঙ্করাচার্য্য ব্রাহ্মণ্যধৰ্ম্ম পুনঃপ্রতিঠিত করেছেন। দ্বিতীয়বার নামলেন অনেকদিন পরে; নামতে নামতে শুনলেন যবনেরা ভারতে প্রবেশ করেচে-শুনে আর না নেমে গিয়ে উঠে নিজের আসনে চলে গেলেন, অনেকদিন আর নামেন নি।
পুষ্প ও যতীন রুদ্ধকণ্ঠে শুনছিল। পুষ্প অধীর কোইতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস্ করলে–আর একবার কখন্ নেমেছিলেন?
–আমি তখন এ জন্মের পরেও দেহত্যাগ করেচি–এই সেদিন, পৃথিবীর হিসেবে বড়জোর সত্তর আশি বছর হবে। বড় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল ভারতব্যাপী, আমরা অনেকে দলবদ্ধ হয়ে নেমে যাই ভারতে যদি কোন প্রতিকার করতে পারি। ওঁকেও নিয়েছিলাম আমাদের সঙ্গে। কুম্ভমেলা সেবার প্রয়াগে। উনি মেলা দর্শন করে দশদিন থেকে ওপরে উঠে যান–সেই শেষ, আর লোকালয়ে যান নি।
ক্ষেমদাস প্রশ্ন করলেন–এখনও দেহে রয়েছেন কেন?