একবার ভাবিল–কুসুমকে আনবো?
পরক্ষণেই স্থির করিল, তার দরকার নাই। লোকে কে কি বলিবে, পদ্ম ঝি তো বঁটি পাতিয়া কুটিবে কুসুমকে। যাক, নিজেই যাহা হয় করিয়া লইবে এখন।
বেলা হইয়াছে। হাজারি বাজার হইতে কেনা তরি-তরকারী, মাংস নিজেই কুটিয়া বাছিয়া লইয়া রান্না চাপাইয়া দিল। বর্ষাও যেন নামিয়াছে হিমালয় পাহাড় ভাঙিয়া। কাঠগুলা ভিজিয়া গিয়াছে–মাংস সে কয়লার জালে রাঁধিবে না। তাহার সে বিশেষ প্রণালীর মাংস রান্না কয়লার জ্বালে হইবে না।
সব রান্না শেষ হইতে বেলা দুইটা রাজিয়া গেল। তারপরে খরিদ্দার বাবুরা খাইতে বসিল। মাংস পরিবেশন করিবার অনেক পূর্বেই ওস্তাদ শিল্পীর গর্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সহিত হাজারি বুঝিয়াছে, আজ যে ধরনের মাংস রান্না হইয়াছে–ইহাদের ভাল না লাগিয়া উপায় নাই। হইলও তাই।
বাবুরা বেচু চক্কত্তিকে ডাকাইলেন, হাজারি ঠাকুরের সম্বন্ধে এমন সব কথা বলিলেন যে বেচু চক্কত্তিও যেন অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল সে কথা নিয়া। চাকরকে ছোট করিয়া রাখিয়া মনিবের সুবিধা আছে, তাহাকে বড় করিলেই সে পাইয়া বসিবে।
যাইবার সময় একজন বাবু হাজারিকে আড়ালে ডাকিয়া বলিলেন–তুমি এখানে কত পাও ঠাকুর।
–সাত টাকা আর খাওয়া-পরা।
–এই দুটো টাকা তোমাকে আমরা বকশিশ দিলাম–চমৎকার রান্না তোমার। যখন আবার এদিকে আসবো, তুমি আমাদের রেঁধে খাইও।
হাজারি আমি খুশি হইল। বকশিশ ইহারা হয়তো কিছু দিবেন সে আশা করিয়াছিল বটে, কি দু-টাকা দিবেন তা সে ভাবে নাই।
যাইবার সময় বেচু চক্কত্তির সামনে বাবুরা হাজারি রান্নার আর এক দফা প্রশংসা করিয়া গেলেন। আর একবার শীঘ্রই শিকারে আসিবেন এদিকে। তখন এখানে আসিয়া হাজারি ঠাকুরের হাতে মাংস না খাইলে তাহাদের চলিবেই না। বেশ হোটেল করেছেন চক্কত্তি মশায়।
বেচু চক্কত্তি বিনীত ভাবে কাঁচুমাচু হইয়া বলিল–আজ্ঞে বাবু মশায়েরা রাজসই লোক, সব দেখতে পাচ্ছেন, সব বুঝতে পাচ্ছেন। এই রাণাঘাট রেল-বাজারে হোটেল আছে অনেকগুলো, কিন্তু আপনাদের মত লোক যখনই আসেন, সকলেই দয়া করে এই গরীবের কুঁড়েতেই পায়ের ধূলো দিয়ে থাকেন। তা আসবেন, যখন আপনাদের ইচ্ছা হয়, আগে থেকে একখানা চিঠি দেবেন, সব মজুদ থাকবে আপনাদের জন্যে; বলবেন কলকাতায় ফিরে দু’চার জন আলাপী লোককে–যাতে এদিকে এলে তারাও এখানেই এসে ওঠেন। বাবু–তা আমার বামুনের মজুরীটা?…হেঁ-হেঁ–
–কত মজুরী দেবো?
–তা দিন বাবু একবেলার মজুরী আট আনা দিন।
বাবুরা আরও আট আনা পয়সা বেচুর হাতে দিয়া চলিয়া গেলেন।
বেচু হাজারী ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–ঠাকুর আজ আর বেরিও না কোথাও। বেলা গিয়েচে। উনুনে আঁচ আর একটু পরেই দিতে হবে। পদ্ম কোথায়?
–পদ্মদিদি থালা বাসন বার করচে, ডেকে দেবো?
পদ্ম ঝি আজ যে মুখ ভার করিয়া আছে, হাজারি তাহা বুঝিয়াছিল। আর হোটেলে সকলের সামনে তাহার প্রশংসা করিয়া গিয়াছে বাবুরা, আজ আর কি তাহার মনে সুখ আছে? পদ্ম ঝির মনস্তুষ্টি করিবার জন্য তাহার ভাতের থালায় হাজারি বেশী করিয়া ভাত তরকারি এবং মাংস দিয়াছিল। পদ্ম ঝি কিছুমাত্র প্রসন্ন হইয়াছে বলিয়া মনে হইল না, মুখ যেমন ভার তেমনিই রহিল।
ভাতের থালা উঠাইয়া লইয়া পদ্ম ঝি হঠাৎ প্রশ্ন করিল– রাঁধসা মাংস আর কতটা আছে ঠাকুর?
বলিয়াই ডেকচির দিকে চাহিল। এমন চমৎকার মাংস কুসুমের বাড়ী কিছু দিয়া আসিবে (সে ব্রাহ্মণের বিধবা নয়, মাছ-মাংস খাইতে তাহার আপত্তি নাই) ভাবিয়া ডেকচিতে দেড় পোয়া আন্দাজ মাংস হাজারি রাখিয়া দিয়াছিল–পদ্ম ঝি কি তাহা দেখিতে পাইল?
পদ্ম দেখিয়াছে বুঝিয়া হাজারি বলিল–সামান্য একটু আছে।
–কি হবে ওটুকু? আমায় দাও না-আমার আজ ভাগ্নীজামাই আসবে–তুমি ত মাংস খাও না–
কুসুমের জন্য রাখা মাংস পদ্ম ঝিকে দিতে হইবে–যার মুখ দেখিতে ইচ্ছা করে না হাজারির! হাজারি মাংস খায় না তাহা নয়, হোটেলে মাংস রান্না হইলেই হাজারি নিজের ভাগের মাংস লুকাইয়া কুসুমকে দিয়া আসে–নিজেকে বঞ্চিত করিয়া। পদ্ম ঝি তাহা জানে, জানে বলিয়াই তাহাকে আঘাত করিয়া প্রতিশোধ লইবার ইচ্ছা উহার মনে জাগিয়াছে ইহাও হাজারি বুঝিল।
হাজারি বলিল–তোমায় তো দিলাম পদ্মদিদি, একটুখানি পড়ে আছে ডেকচির তলায় ওটুকু আর তুমি কি করবে?
–কি করবো বললুম, তা তোমার কানে গেল না? ভাগ্নীজামাই এসেছে শুনলে না? যা দিলে এতটুকুতে কি কুলুবে? ঢেলে দাও ওটুকু।
হাজারি বিপন্ন মুখে বলিল–আমি একটু রেখে দিইছি, আমার দরকার আছে।
পদ্ম ঝি ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া শ্লেষের সুরে বলিল–কি দরকার? তুমি তো খাও না–কাকে দেবে শুনি?
হাজারি বলিল–দেবো–ও একজন একটু চেয়েছে–
–কে একজন?
–আছে–ও সে তুমি জানো না।
পদ্ম ঝি ভাতের থালা নামাইয়া হাত নাড়িয়া বলিল–না, আমি জানিনে। তা কি আর জানি? আর সে জানা-জানি, আমার দরকার নেই। হোটেলের জিনিস তুমি কাউকে দিতে পারবে না, তোমায় অনেকদিন বলে দিইছি। বেশ তুমি আমায় না দাও, চক্কত্তি মশায়ের শালাও আজ কলকাতা থেকে এসেছে–তার জন্যে মাংস বাটি করে আলাদা রেখে দাও–ওবেলা এসে খাবে এখন। আমি না পেতে পারি, সে হোটেলের মালিকের আপনার লোক, সে তো পেতে পারে?
বেচু চক্কত্তির এই শালাটিকে হাজারি অনেকবার দেখিয়াছে–মাসের মধ্যে দশ দিন আসিয়া ভগ্নীপতির বাড়ী পড়িয়া থাকে, আর কালাপেড়ে ধুতি পরিয়া টেরি কাটিয়া হোটেলে আসিয়া সকলের উপর কর্তৃত্ব চালায়–কথায় কথায় ঠাকুর-চাকরকে অপমান করে; চোখ রাঙায়, যেন হোটেলের মালিক নিজেই।