স্বামীকে কথাটা বলিতে হাজারি বলিল–তোমার ইচ্ছে যা হয় করো–কিন্তু তার আগে ঘরখানা তো সারানো দরকার। ঘরে জল পড়ে ভেসে যায়, থাকবে কিসে?
টেঁপির মা বলিল–সে ভাবনায় তোমার দরকার নেই। আমি অতসীদের বাড়ী থেকে কি ওই মুখূয্যের বাড়ী থেকে ঘর সারিয়ে নেব। জামাইকে বলে যেও খরচ যা লাগে যেন দেয়।
.
রাধু মুখূয্যের বাড়ী রাত্রে আহারের আয়োজন ছিল যথেষ্ট–খিচুড়ি, ভাজাভুজি, মাছ, ডিমের ডালনা, বড়াভাজা, টক, দই, আম, সন্দেশ। অতসীকেও খাইতে বলা হইয়াছিল কিন্তু সে আসে নাই। টেঁপি ডাকিতে গেলে কিন্তু অতসী বলিল, তাহার মাথা ভয়ানক ধরিয়াছে, সে যাইতে পারিবে না।
শেষরাত্রে দুখানা গাড়ী করিয়া সকলে আবার রাণাঘাট আসিল। দুপুরের পর হাজারি একটু ঘুমাইয়া লইল। ট্রেন নাকি সারারাত চলিবে, কখনও সে অতদূর যায় নাই, অতক্ষণ গাড়ীতেও থাকে নাই। ঘুম হইবে না কখনই। যাইবার সময়ে টেঁপির মা ও টেঁপি কাঁদিতে লাগিল। কুসুমও ইহাদের সঙ্গে যোগ দিল।
অতসী সকলকে বুঝাইতে লাগিলছি—ছিঃ, কাঁদে না, ওকি কাকীমা? বিদেশে যাছেন একটা মঙ্গলের কাজ, ছিঃ টেঁপি, অমন চোখের জল ফেলো না ভাই।
হাজারি ঘরের বাহির হইয়াছে, সামনেই পদ্মঝি।
পদ্মঝি বলিল–এখন এই গাড়ীতে যাবেন ঠাকুর মশায়?
–হ্যাঁ, পদ্মদিদি এবেলা খদ্দের কত?
–তা চল্লিশ জনের ওপর। সেকেন কেলাস বেশী।
–ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছিলে তো?
পদ্মঝি হাসিয়া বলিল–ওমা, তা আর বলতে হবে? যতদিন বাজারে পাই, ততদিন ইলিশের বন্দোবস্ত। আষাঢ় থেকে আশ্বিন–দেখেছিলাম তো ও হোটেলে!
–হ্যাঁ সে তোমাকে আর আমি কি শেখাবো? তুমি হোলে গিয়ে পুরোনো লোক। বেশ হুঁশিয়ার থেকো পদ্মদিদি। ভেবো তোমায় নিজেরই হোটেল।
পদ্মঝি এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটাইল। হঠাৎ ঝুঁকিয়া নীচু হইয়া বলিল–দাঁড়ান ঠাকুর মশাই, পায়ের ধূলোটা দেন একটু—
হাজারি অবাক, স্তম্ভিত। চক্ষুকে বিশ্বাস করা শক্ত। এ কি হইয়া গেল! পদ্মদিদি তাহার পায়ের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া পায়ের ধূলা লইতেছে! এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করিবার দুঃসাহসও কখনো তাহার হয় নাই। কোন সৌভাগ্যটা বাকী রহিল তাহার জীবনে?
স্টেশনে তুলিয়া দিতে আসিল দুই হোটেলের কর্মচারীরা প্রায় সকলে–তা ছাড়া অতসী, টেঁপি, নরেন। বাহিরের লোকের মধ্যে যদু বাঁড়ুয্যে। যদু বাঁড়ুয্যে সত্যই আজকাল হাজারিকে যথেষ্ট মানিয়া চলে। তাহার ধারণা হোটেলের কাজে হাজারি এখনও অনেক বেশী উন্নতি দেখাইবে, এই তো সবে শুরু।
অতসী পায়ের ধূলা লইয়া বলিল–আসবেন কিন্তু পুজোর সময় কাকাবাবু, মেয়ের বাড়ীর নেমন্তন্ন বইল। ঠিক আসবেন–
টেঁপি চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল–খাবারের পুঁটুলিটা ওপরের তাক থেকে নামিয়ে কাছে রাখো বাবা, নামাতে ভুলে যাবে, তোমার তো হুঁশ থাকে না কিছু। আর রাত্তিরেই খেও, ভুলো না যেন। কাল বাসি হয়ে যাবে, পথেঘাটে বাসি খাবার খবরদার খাবে না। মনে থাকবে? তোমার চিঠি পেলে মা বলেচে রাধাবল্লভতলায় পুজো দেবে।
চলন্ত ট্রেনের জানালার ধারে বসিয়া হাজারির কেবলই মনে হইতেছিল পদ্মদিদি যে আজ তাহার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল এ সৌভাগ্য হাজারির সকল সৌভাগ্যকে ছাপাইয়া ছাড়াইয়া গিয়াছে।
সেই পদ্মদিদি!
ঠাকুর রাধাবল্লভ, জাগ্রত দেবতা তুমি, কোটি কোটি প্রণাম তোমার চরণে। তুমিই আছ। আর কেহ নাই। থাকিলেও জানি না।