হাজারি কথাটার সত্যতা বুঝিল। বলিল–আপনি কি বলেন কর্তা?
–আমার মত হচ্ছে এই যে ফাস্ট কেলাস হয় একদম উঠিয়ে দাও, নয়তো আমার হোটেলের মত অন্ততঃ দুআনা তফাৎ রাখো। শীতকালে যখন সব সস্তা, তখন এ থেকে যা লাভ হবে, বর্ষাকালে বা অন্য সময় ফাস্ট কেলাসের খদ্দেরদের পেছনে সেই লাভের খানিকটা খেয়ে গিয়েও যাতে কিছু থাকে, তা করতে হবে। বুঝলে না?
–তাই করুন কর্তা। আপনি যা বোঝেন, আমি কি আর তত বুঝি?
বেচু চক্কত্তি খুব সন্তুষ্ট আছেন হাজারির ব্যবহারে। ঠিক সেই পুরোনো দিনের মতই হাজারির নম্র কথাবার্তা–যেন তিনিই মনিব, হাজারি তার চাকর। যদিও পদ্মঝি ও তিনি দুজনেরই দৃঢ় বিশ্বাস হাজারি যা কিছু করিয়া তুলিয়াছে, সবই কপালের গুণে, আসলে তাহার বুজিসুদ্ধি কিছুই নাই, তবুও দুজনেই এখন মনে ভাবে, বুদ্ধি যত খাক আর না-ই থাক–বুদ্ধি অবশ্য সকলের থাকে না–লোক হিসাবে হাজারি কিন্তু খুবই ভাল।
.
সকালে উঠিয়া হাজারি এক কলিকা গাঁজা সাজিবার উদ্যোগ করিতেছে। এই সময়টা সকলের অগোচরে সে একবার গাঁজা খাইয়া থাকে, হোটেলে গিয়া আজকাল সে-সুবিধা ঘটে না। এমন সময় অতসীকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি গাঁজার কলিকা ও সাজসরঞ্জাম লুকাইয়া ফেলিল।
অতসীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–কি মা?
–কাকাবাবু, আপনি কবে বম্বে যাচ্ছেন?
–আসছে মঙ্গলবার যাব, আর চার দিন বাকি।
–আমার বড় ইচ্ছে হচ্ছে আপনাকে নিয়ে এঁড়োশোলা যাব, আমাদের বৈঠকখানায় আবার আপনাকে আর বাবাকে চা জলখাবার এনে দেবো–যাবেন কাকাবাবু?
হাবির চোখে জল আসিল। কি তুচ্ছ সাধ! মেয়েদের মনে এই সব অতি সামান্য আশা-আকাঙ্খাই কি সব সময়ে পূর্ণ হয়? কি করিয়া সে এঁড়োশোলা যাইবে এখন? ছেলে-মানুষ, না হয় বলিয়া খালাস!
মুখে বলিল–মা, সে হয় না। কত কাজ বাকি এদিকে, সে-তো মা জান না। নরেন ছেলেমানুষ, ওকে সব জিনিস দেখিয়ে বুঝিয়ে না দিয়ে–
–আজ চলুন আমায় নিয়ে। গরুর গাড়ীতে আমরা বাপে-মেয়েতে চলে যাই–কাল বিকেলে চলে আসবেন। তা ছাড়া টেঁপিও বলছিল একবার গাঁয়ে যাবার ইচ্ছে হয়েছে। চলুন কাকাবাবু, চলুন–
–তা নিতান্ত যদি না ছাড় মা, তবে পরশু সকালে গিয়ে সেই দিনই সন্ধ্যার পরে ফিরতে হবে। থাকবার একদম উপায় নেই–কারণ তার পরদিনই বিকেলে রওনা হতে হবে আমায়। বোম্বাইয়ের ডাকগাড়ী রাত আটটায় ছাড়ে বলে দিয়েছে।
.
বৈকালে চূর্ণীর ধারের নিমগাছটার তলায় হাজারি একবার গিয়া বসিল। পাশের চুন-কয়লার আড়তে হিন্দুস্থানী কুলিরা সেই ভাবে সুর করিয়া সমস্বরে ঠেঁট হিন্দীতে গজল গাহিতেছে, চূর্ণীর খেয়াঘাটে ওপারের ফুলে-নবলার হাটের হাটুরে লোক পারাপার হইতেছে– পুরোনো দিনের মতই সব।
সে কি আজও বেচু চক্কত্তির হোটেলে কাজ করিতেছে? পদ্মঝিয়ের মুখনাড়া খাইয়া তাহাকে কি এখনি সদ্য আঁচ বসানো কয়লার উনুনের ধোঁয়ার মধ্যে বসিয়া ও-বেলার রান্নার ফর্দ বুঝিয়া লইতে হইবে?
সেই পদ্মদিদি ও সেই বেচু চক্কত্তির সঙ্গে সকালবেলাও তো কথাবার্তা হইয়াছিল। দাঁড়িপাল্লায় পাল্লা বদল হইয়াছে, পুরোনো দিনের সম্বন্ধগুলি ছায়াবাজির মত অন্তর্হিত হইল কোথায়? বোম্বাই…বোম্বাই কত দূরে কে জানে? টেঁপিকে লইয়া, অতসী বা কুসুমকে লইয়া যদি যাওয়া যাইত! ইহারা যে-কেহ সঙ্গে থাকিলে সে বিলাত পৰ্য্যত যাইতে পারে– দুনিয়ার যে-কোন জায়গায় বিনা আশঙ্কায় বিনা দ্বিধায় চলিয়া যাইতে পারে।
তখনকার দিনে সে কি একবারও ভাবিয়াছিল আজকার মত দিন তাহার জীবনে আসিবে? নরেনকে যেদিন প্রথম দেখে সেইদিনই মনে হইয়াছিল যে সুন্দর ছবিটি-–টেঁপি লাল চেলি পরিয়া নরেনের পাশে দাঁড়াইয়া, মুখে লজ্জা, চোখে চাপা আনন্দের হাসি–তখন মনে হইয়াছিল এসব দুরাশা, এও কি কখনও হয়?
সবই ঠাকুর রাধাবল্লভের দয়া। নতুবা সে আবার কবে ভাবিয়াছিল যে সে বোম্বাই যাইবে দেড়-শ টাকা মাহিনার চাকুরি লইয়া?
পরদিন অতসী আসিয়া আবার বলিল–কবে এঁড়োশোলা যাবেন কাকাবাবু? টেঁপিও যাবে বলছে, কাকীমাও বলছিলেন গাঁয়ে থেকে সেই অজি দু-বছর আড়াই বছর এসেছেন আর কখনও যান নি। ওঁরও যাবার ইচ্ছে। একদিনের জন্যেও চলুন না?
.
আবার স্বগ্রামে আসিয়া উহাদের গাড়ী চুকিল বহুদিন পরে। হাজারিদের বাড়ীটা বাসযোগ্য নাই, খড়ের ঘর এত দিন দেখাশোনার অভাবে নষ্ট হইয়া গিয়াছে–ঝড়ে খড় উড়িয়া যাওয়ার দরুন চালের নানা জায়গা দিয়া নীল আকাশ দিব্যি চোখে পড়ে।
অতসী টানাটানি করিতে লাগিল তাদের বাড়ীতে সবসুদ্ধ লইয়া যাইবার জন্য, কিন্তু টেঁপির মা রাজী নয়, নিজের ঘরদোরের উপর মেয়েমানুষের চিরকাল টান–ভাঙা ঘরের উঠানের জঙ্গল নিজের হাতে তুলিয়া ফেলিয়া টেঁপির সাহায্যে ঘরের দাওয়া ও ভিতরকার মেজে পরিষ্কার করিয়া নিজের বাড়িতেই সে উঠিল। টেঁপিকে বলিল–তুই বস মা, আমি পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আসি, পেয়ারাতলার ঘাটে কতদিন নাই নি।
পুকুরের ঘাটে গিয়ে এ-পাড়ার রাধু চাটুজ্জের পুত্রবধুর সঙ্গে প্রথমেই দেখা। সে মেয়েটির বয়স প্রায় টেঁপির মায়ের সমান, দুজনে যথেষ্ট ভাব চিরকাল। টেঁপির মাকে দেখিয়া সে তো একেবারে অবাক–বাসন মাজা ফেলিয়া হাসিমুখে ছুটিয়া আসিয়া বলিল–ওমা, দিদি যে! কখন এলে দিদি? আর কি আমাদের কথা মনে থাকবে তোমার? এখন বড়লোক হয়ে গিয়েচ সবাই বলে। গরীবদের কথা কি মনে পড়ে?