একজন সাক্ষী বলিল –তা দেবেন কেমন করে বাপু? ওর নামে তো ডিক্রি নেই আদালতের। ও আদালতের ডিক্রি মানতে যাবে কেন?
বেলিফ বলিল–তা নয়, ওকে চুরির চার্জে ফেলে পুলিশে দেওয়া চলবে। এ হোটেল এখন মহাজন পাওনাদারের। তার ঘর থেকে অপরের জিনিস নিয়ে যাবার রাইট কি? ওকে জিজ্ঞেস করো ও ভালোয় ভালোয় দেবে কিনা–
পদ্মঝি তা দিতে রাজী নয়। সে আরও জোর করিয়া আঁকড়াইয়া আছে বাতি দুটি। বেলিফ বলিল–কেড়ে নাও মাল ওর কাছ থেকে–বদমাইশ মাগী কোথাকার–ভাল কথায় কেউ নয়।
পেয়াদারা এবার বীরদর্পে আসিয়া গেল। পুনরায় একচোট ধস্তাধস্তির সূত্রপাত হইবার উপক্রম হইতেই হাজারি সেখানে গিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–পদ্মদিদি, বাসন ওদের দিয়ে দাও।
লজ্জায় ও অপমানে পদ্মঝিয়ের চোখে তখন জল আসিয়াছে। জনতার সামনে দাঁড়াইয়া এমন অপমানিত সে কখনো হয় নাই। এই সময় হাজারিকে দেখিয়া সে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
–এই দেখোনা ঠাকুর মশায়, তুমি তো কতদিন আমাদের হোটেলে ছিলে–এ আমার জিনিস না? বলো না তুমি, এ বালতি কার?
হাজারি সান্ত্বনার সুরে বলিল–কেঁদো না এমন করে পদ্মদিদি। এ হোল আইন-আদালতের ব্যাপার। বাসন রেখে এসো ঘরের মধ্যে, আমি দেখছি তারপর কি ব্যবস্থা করা যায়–
অবশ্য তখন কিন্তু করিবার উপায় ছিল না। সে আদালতের বেলিফকে জিজ্ঞাসা করিল–কি করলে এদের হোটেল আবার বজায় থাকে?
–টাকা চুকিয়ে দিলে। এ অতি সোজা কথা মশাই। সাড়ে সাতশো টাকার দাবীতে নালিশ–এখনও ডিক্রী হয় নি। বিচারের আগে সম্পত্তি সীল না করলে দেনাদার ইতিমধ্যে মাল হস্তান্তর করতে পারে, তাই সীল করা।
আদালতের পেয়াদারা কাজ শেষ করিয়া চলিয়া গেল। বেচু চক্কত্তিকে একবারে ডাকিয়া হাজারি বলিল–আমার সঙ্গে চলুন না কর্তা মশায় একবার ইষ্টিশনের দিকে–আসুন, কথা আছে।
রেলের হোটেলে নিজের ঘরটিতে বেচু চক্কত্তিকে বসাইয়া হাজারি বলিল–কর্তা একটু চা খাবেন?
বেচু চক্কত্তির মন খারাপ খুবই। চা খাইতে প্রথমটা চাহে নাই, হাজারি কিছুতেই ছাড়িল না। চা পান ও জলযোগান্তে বেচু বলিল–হাজারি, তুমি তো সাত-আট বছর আমার সঙ্গে ছিলে, জানো তো সবই, হোটেলটা ছিল আমার প্রাণ। আজ বাইশ বছর হোটেল চালাচ্ছি –এখন কোথায় যাই আর কি করি। পৈতৃক জোতজমা ঘরদোর যা ছিল ফুলে-নবলায়, সে এখন আর কিছু নেই, ওই হোটেলই ছিল বাড়ী। এমন কষ্ট হয়েছে, এই বুড়ো বয়সে এখন দাঁড়াই কোথায়? চালাই কী করে?
–এমন অবস্থা হোল কি করে কর্তা? দেনা বাধালেন কী করে?
–খরচে আয়ে এদানীং কুলোতো না হাজারি। দু-বার বাসন চুরি হয়ে গেল। ছোট হোটেল, আর কত ধাক্কা সইবার জান ছিল ওর! কাবু হয়ে পড়লো। খদ্দের কমে গেল। বাড়ীভাড়া জমতে লাগলো–এসব নানা উৎপাত–
হাজারি বেচু চক্কত্তিকে তামাক সাজিয়া দিয়া বলিল–কর্তা, একটা কথা আছে বলি। আপনি আমার পুরনো মনিব, আমার যদি টাকা এখন থাকতো, আপনার হোটেলের সীল আমি খুলিয়ে দিতাম। কিন্তু কাল মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন অত টাকা আমার হাতে নেই। তাই বলচি, যতদিন বম্বে থেকে না ফিরি, আপনি আমার বাজারের হোটেলের ম্যানেজার হয়ে হোটেল চালান। পঁচিশ টাকা করে আপনার খরচ দেবো। (হাজারি মাহিনার কথাটা মনিবকে বলিতে পারিল না।) খাবেন দাবেন হোটেলে, আর পদ্মাদিদিও ওখানে থাকবে, মাইনে পাবে, খাবে। কি বলেন আপনি?
বেচু চক্কত্তির পক্ষে ইহা অস্বপনের স্বপন। এ আশা সে কখনো করে নাই। রেলবাজারের অত বড় কারবারী হোটেলের সে ম্যানেজার হইবে। পদ্মঝিও খবরটা পাইয়াছিল বোধ হয় বেচুর কাছেই, সেদিন সন্ধ্যাবেলা সে কুসুমের বাড়ী গেল। কুসুম উহাকে দেখিয়া কিছু আশ্চৰ্য্য না হইয়া পারিল না, কারণ জীবনে কোনোদিন পদ্মঝি কুসুমের দোর মাড়ায় নাই।
–এসো পদ্মপিসি বসো। আমার কি ভাগ্যি। এই পিঁড়িখানতে বোসো পিসি। পান-দোক্তা খাও? বসো পিসি, সেজে পানি–
পদ্মঝি বসিয়া পান খাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া কুসুমের সঙ্গে এ-গল্প ও-গল্প করিল। পদ্ম বুঝিতে পারিয়াছে কুসুমও তাহার এক মনিব। ইহাদের সকলকে সন্তুষ্ট রাখিয়া তবে চাকুরি বজায় রাখা। যদিও সে মনে মনে জানে, চাকুরি বেশী দিন তাহাকে করিতে হইবে না। আবার একটা হোটেল নিজেরাই খুলিবে, তবে বিপদের দিনগুলিতে একটা কোনো আশ্রয়ে কিছুদিন মাথা গুঁজিয়া থাকা।
১১. পদ্মঝি হোটেলের কাজে ভর্তি হইল
পরদিন পদ্মঝি হোটেলের কাজে ভর্তি হইল। বেচু চক্কত্তিও বসিল গদির ঘরে। ইহারা কেহই যে বিশ্বাসযোগ্য নয় তাহা হাজারি ভাল করিয়াই বুঝিত। তবে কথা এই যে, ক্যাশ থাকিবে নরেনের কাছে। বেচু চক্কত্তি দেখাশোনা করিয়াই খালাস।
হাজারির মনে হইল সে তাহার পুরোনো দিনের হোটেলে আবার কাজ করিতেছে, বেচু চক্কত্তি তাহার মনিব, পদ্মঝিও ছোট মনিব।
পদ্ম যখন আসিয়া সকালে জিজ্ঞাসা করিল–-ঠাকুর মশায়, ইলিশ মাছ আনাব এবেলা না পোনা?–তখন হাজারি পূর্ব অভ্যাসমতই সম্ভ্রমের সঙ্গে উত্তর দিল, যা ভাল মনে করো পদ্মদিদি। পচা না হোলে ইলিশই এনো।
বেচু চক্কতি পাকা ব্যবসাদার লোক এবং হোটেলের কাজে তাহার অভিজ্ঞতা হাজারির অপেক্ষা অনেক বেশী। সে হাজারিকে ডাকিয়া বলিল–হাজারি, একটা কথা বলি, তোমার এখানে ফাস্ট আর সেকেন কেলাসের মধ্যে মোট চার পয়সার তফাৎ রেখেচ, এটা ভাল মনে হয় না আমার কাছে। এতে করে সেকেন কেলাসে খদ্দের কম হচ্ছে, বেশী লোক ফাস্ট কেলাসে খায় অথচ খরচ যা হয় তাদের পেছনে তেমন লাভ দাঁড়ায় না। গত এক মাসের হিসেব খতিয়ে দেখলাম কিনা! নরেন বাবাজী ছেলেমানুষ, সে হিসেবের কি বোঝে?