অবাঙালী ভদ্রলোকটি হাসিমুখে হিন্দীতে কি বলিলেন, হাজারি ভাল বুঝিল না। বিনীত ভাবে বাঙালী বাবুটিকে বলিল যে সে হিন্দী বুঝিতে পারে না।
বাঙালী বাবুটি বলিলেন–শুনুন হাজারিবাবু, কথাটা বলি। আমার বন্ধু ইনি গুজরাটি। বড় ব্যবসাদা, ধুরন্ধর খাড্ডে কোম্পানীর বড় অংশীদার। জি. আই. পি. রেলের সব হিন্দু রেস্টোরান্টের কন্ট্রাক্ট হোল খাড্ডে কোম্পানি। ওরা আপনাকে বলতে এসেছে ওদের সব হোটেলের রান্না দেখাশুনা তদারক করবার জন্যে দেড়শো টাকা মাইনেতে আপনাকে রাখতে চায়। তিন বছরের এগ্রিমেন্ট। আপনার সব খরচ, রেলের যে কোনো জায়গায় যাওয়া-আসা, একজন চাকর ওরা দেবে। বম্বেতে ফ্রি কোয়ার্টার দেবে। যদি ওদের নাম দাঁড়িয়ে যায় আপনার রান্নার গুণে আপনাকে একটা অংশও ওরা দেবে। আপনি রাজী?
হাজারি নরেনকে ডাকিয়া আলোচনা করিল আড়ালে। মন্দ কি? কাজকর্ম এদিকে যাহা রহিল নরেন দেখাশুনা করিতে পারে। খরচ বাদে মাসে তিনি দেড় শত টাকা কম নয়–তা ছাড়া হোটেলের ব্যবসা সম্বন্ধে খুব একটা অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ এটি। এ হাতছাড়া করা উচিত হয় না–নরেনের ইহাই মত।
হাজারি আসিয়া বলিল–আমি রাজী আছি। কবে যেতে হবে বলুন। কি একটা কথা আছে-হিন্দী তো আমি তত জানিনে! কাজ চালাব কি করে?
বাঙালী বাবু বলিলেন–সেজন্যে ভাবনা নেই। দুদিন থাকলেই হিন্দী শিখে নেবেন। সই করুন এ কাগজে। এই আপনার কন্ট্রাক্ট ফর্ম, এই এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। দুজন সাক্ষী ডাকুন।
যদু বাঁড়ুয্যেকে ডাকিয়া আনা হইল তাহার হোটেল হইতে, অন্য সাক্ষী নরেন। কাগজ পরে হাঙ্গামা চুকিয়া গেলে উহারা চা-পানে আপ্যায়িত হইয়া ট্রেনে উঠিল। বাঙালী ভদ্রলোক বলিয়া গেল–মে মাসের পয়লা জয়েন করতে হবে আপনাকে বম্বেতে। আপনার ইন্টার ক্লাস রেলওয়ে পাস আসছে আর আমাদের লোকে আপনাকে সঙ্গে করে বম্বে পৌঁছে দেবে। তৈরী থাকবেন–আর পনেরো দিন বাকী।
.
হাজারি স্টেশন হইতে বাহির হইয়াই কুসুমের সঙ্গে একবার দেখা করিবে ভাবিল। এত বড় কথাটা কুসুমকে বলিতেই হইবে আগে। বোম্বাই! সে বোম্বাই যাইতেছে। দেড়শো টাকা মাহিনায়! বিশ্বাস হয় না। সব যেন স্বপ্নের মত ঘটিয়া গেল। টাকার জন্য নয়। টাকা এখানে সে মাসে দেড়শো টাকার বেশী ছাড়া কম রোজগার করে না। কিন্তু মানুষের জীবনে টাকাটাই কি সব? পাঁচটা দেশ দেখিয়া বেড়ানো, পাঁচজনের কাছে মান-খাতির পাওয়া, নূতনতর জীবনযাত্রার আস্বাদ–এ সবই তো আসল।
পিছন হইতে যদু বাঁড়ুয্যে ডাকিল–ও হাজারি-ভায়া, হাজারি-ভায়া শোন, হাজারি-ভায়া–
হাজারি কাছে যাইতেই যদু বাঁড়ুয্যে–রাণাঘাটের হোটেলের মালিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যে–সেই যদু বাঁড়ুয্যে স্বয়ং নীচু হইয়া হাজারির পায়ের ধূলো লইতে গেল। বলিল–ধন্যি, খুব দেখালে ভায়া, হোটেল করে তোমার মত ভাগ্যি কারো ফেরে নি। পায়ের ধূলো দাও, তুমি সাধারণ লোক নও দেখছি–
হাজারি হা-হা করিয়া উঠিল।
–কি করেন বাঁড়ুয্যেমশায়–আমার দাদার সমান আপনি—ওকি—ওকি–আপনাদের বাপমায়ের আশীর্বাদে, আপনাদের আশীর্বাদে–একরকম করে খাচ্ছি–
যদু বাঁড়ুয্যে বলিল—এসো না ভায়া গরীবের হোটেলে একবার এক ছিলি তামাক খেয়ে যাও–এসো।
যদু বাঁড়ুয্যের অনুরোধ হাজারি এড়াইতে পারিল না। যদু চা খাওয়াইল, ছানার জিলাপি খাওয়াইল, নিজের হাতে তামাক সাজিয়া খাইতে দিল। স্বপ্ন না সত্য? এই যদু বাঁড়ুয্যে একদিন নিজের হোটেলে কাজ করিবার জন্য না ভাঙাইতে গিয়াছিল! তাহার মনিবের দরের মানুষ ছিল তিন বছর আগেও!
না, যথেষ্ট হইল তাহার জীবনে। ইহার বেশী আর সে কিছু চায় না। রাধাবল্লভ ঠাকুর তাহাকে অনেক দিয়াছেন। আশার অতিরিক্ত দিয়াছেন।
.
কুসুম শুনিয়া প্রথমে ঘোর আপত্তি তুলিয়া বলিল–জ্যাঠামশায় কি ভাবেন, এই বয়সে তাঁহাকে সে অত দূরে যাইতে কখনই দিবে না। জেঠিমাকে দিয়াও বারণ করাইবে। আর টাকার দরকার নাই। সে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের দেশে যাইতে হইবে এমন গরজ কিসের?
হাৰি বলিল–মা বেশীদিন থাকব না সেখানে। চুক্তি সই হয়ে গিয়েছে সাক্ষীদের সামনে। না গেলে ওরা খেসারতের দাবি করে নালিশ করতে পারে। আর একটা উদ্দেশ্য আছে কি জান মা, বড় বড় হোটেল কি করে চালায়, একবার নিজের চোখে দেখে আসি। আমার তো ঐ বাতিক, ব্যবসাতে যখন নেমেছি, তখন এর মধ্যে যা কিছু আছে শিখে নিয়ে তবে ছাড়ব। বাধা দিও না মা, তুমি বাধা দিলে তো ঠেলবার সাধ্যি নেই আমার।
টেঁপির মা ও টেঁপি কান্নাকাটি করিতে লাগিল। ইহাদের দুজনকে বুঝাইল নরেন। মামাবাবু কি নিরুদ্দেশ যাত্রা করিতেছেন? অত কান্নাকাটি করিবার কি আছে ইহার মধ্যে। বম্বে তো বাড়ীর কাছে, লোকে কত দূর-দূরান্ত যাইতেছে না চাকুরির জন্য?
সেই দিন রাত্রে হাজারি নরেনের মামা বংশীধর ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–একটা কথা আছে। আমি তো আর দিন পনেরোর মধ্যে বোম্বাই যাচ্ছি। আমার ইচ্ছে যাবার আগে টেঁপির সঙ্গে নরেনের বিয়েটা দিয়ে যাব। নরেন এখানকার কারবার দেখাশুনা করবে–রেলের হোটেলটা ওকে নিজে দেখতে হবে–ওটাতেই মোটা লাভ। এতে তোমার কি মত?
বংশীধর অনেকদিন হইতেই এইরূপ কিছু ঘটিবে আঁচ করিয়া রাখিয়াছিল। বলিল হাজারিদা, আমি কি বলব, বল। তোমার সঙ্গে পাশাপাশি হোটেলে কাজ করেছি। আমরা সুখের সুখী দুঃখের দুঃখী হয়ে কাটিয়েছি বহুকাল। নরেনও তোমারই আপনার ছেলে। যা বলবে তুমি, তাতে আমার অমত কি? আর ওরও তো কেউ নেই–সবই জান তুমি। যা ভাল বোঝ কর।