–কি গান গাইলে! চমৎকার গান, বাবা। আমি দুটো শিখে ফেলেছি।
–কি গান রে?
–একটা হোল তোমারি পথ চেয়ে থাকব বসে চিরদিন–চমৎকার সুর বাবা। শুনবে? বেশ গাইতে পারি এটা–
–থাক এখন আর দরকার নেই। অন্য সময়…এখন একটু কাজ আছে।
টেঁপি মনক্ষুণ্ণ হইল। এমন গানটা বাবাকে শোনাইতে পারিলে খুশি হইত। তা নয় বাবার সব সময় কেবল কাজ আর কাজ!
টেঁপির মা বলিল–ওগো, কাল পল্প বলে একটা মেয়ে এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। বেশ লোকটা। ওদের হোটেলে তুমি নাকি কাজ করতে!…
হাজারি আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিল–কি বললে পদ্মদিদি?
–গল্প করলে বসে, পান সেজে দিলাম, খেলে। ওদের সে হোটেল উঠে যাচ্ছে। আর চলে না, এই সব বলে।
হাজারি এখনও পদ্মকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে। পদ্মদিদি–সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ পদ্মদিদি তাহার বাড়ীতে আসিয়াছিল বেড়াইতে– তাহার স্ত্রীর সহিত যাচিয়া আলাপ করিতে–হাজারি নিজেকে অত্যন্ত সম্মানিত বিবেচনা করিল–-পদ্মঝি তাহার বাড়ীতে পদধূলি দিয়া যেন তাহাকে কৃতার্থ করিয়া দিয়া গিয়াছে।
টেঁপি বলিল–বাবা, নরেনদাদাকে আমি নেমন্তন্ন করেছি। নয়েন-দা বলেছে আমাকে মাংস রেঁধে খাওয়াতে হবে। তুমি মাংস এনে দাও—
১০. কুসুমের বাড়ী যাইবার জন্য রওনা
হাজারি এদিকের সব কাজ মিটাইয়া কুসুমের বাড়ী যাইবার জন্য রওনা হইল, পথে হঠাৎ পদ্মঝিয়ের সঙ্গে দেখা। পদ্মঝিয়ের পরনে মলিন বস্ত্র। কখনও হাজারি জীবনে যাহা দেখে নাই।
হাজারি বলিল–হাতে কি পদ্মদিদি? যাচ্ছ কোথায়?
পদ্ম হাজারিকে দেখিয়া দাঁড়াইল, বলিল–ঠাকুরমশায়, কবে ফিরলে? হাতে তেঁতুল, একটু নিয়ে এলাম হোটেল থেকে।
হাজারি মনে মনে হাসিল। হোটেল হইতে লুকাইয়া জিনিস সরাইবার অভ্যাস এখনও যায় নাই পদ্মদিদির!
হাজারি পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পদ্ম বলিল–শোনো, দাঁড়াও না ঠাকুরমশায়! কাল তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম যে! বলে নি বৌদিদি?
–হ্যাঁ হ্যাঁ বলচিল বটে।
–বৌদিদি লোক বড় ভাল, আমার সঙ্গে কত গল্প করলে। আর একদিন যাব।
–বা, যাবে বৈ কি পদ্মদিদি, তোমাদেরই বাড়ী। যখন ইচ্ছে হয় যাবে। হোটেল কেমন চলছে?
–তা মন্দ চলছে না। এককরম চলছে।
–বেশ বেশ। তাহলে এখন আসি পদ্মদিদি—
হাজারি চলিয়া গেল। ভাবিল–একরকম চলছে বললে অথচ কাল বাড়ীতে বসে গল্প করে এসেছে হোটেল আর চলে না, উঠে যাবে। পদ্মদিদি ভাঙে তো মচকায় না!
কুসুমের বাড়ীতে হাজারি অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলিল। কথায়-কথায় নতুন গাঁয়ের বধুটির কথা মনে পড়াতে হাজারি বলিল–ভাল কথা কুসুম মা চেনো? এঁড়োশোলার বনমালীর স্ত্রীর ভাইঝি–তোমাকে দিদি বলে ডাকে একটি মেয়ে, বিয়ে হয়েছে নতুন গাঁ?
কুসুম বলিল–খুব চিনি। ওর নাম তো সুবাসিনী। ওকে কি করে জানলেন জ্যাঠা মশায়?
হাজারি বধুটির সম্বন্ধে সব কথা খুলিয়া বলিল, তাহার টাকা লইয়া আসা, হোটেলে তাহাকে অংশীদার করার সঙ্কল্প।
কুসুম বলিল–এ তো বড় খুশির কথা। আপনার হোটেলে টাকা খাটলে ওর ভবিষতে একটা হিল্লে হয়ে রইল।
–কিন্তু যদি আজ মরে যাই মা? তখন কোথায় থাকবে হোটেল?
–ও কথা বলতে নেই যাঠামশায়–ছিঃ
কুসুমের অবস্থা আজকাল ফিরিয়াছে। হাজারি তাহাকে শুধু মহাজন হিসাবে দেখে না, হোটেলের অংশীদার হিসাবে প্রতি মাসে ত্রিশ-বত্রিশ টাকা দেয়, মাসিক লাভের অংশরূপ।
কুসুম বলিল–অমন সব কথা বলেন কেন, ওতে আমার কষ্ট হয়। আপনি ছিলেন তাই আজ রাণাঘাট শহরে মাথা তুলে বেড়াতে পারছি, ছেলেপিলে দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পাচ্ছে। এই বাড়ী বাঁধা রেখে গিয়েছিলেন শশুর, আপনাকে বলি নি সে-কথা, এতদিন বাড়ী বিক্রি হয়ে যেতো দেনার দায়ে যদি হোটেল থেকে টাকা না পেতাম মাস মাস। ওই টাকা দিয়ে দেনা সব শোধ করে ফেলেছি–এখন বাড়ী আমার নামে। আপনার দৌলতেই সব জ্যাঠামশায়– আমার চোখে আপনি দেবতা।
হাজারি বলিল–উঠি আজ মা। একবার ইষ্টিশানের হোটেলটাতে যাব। একদল বড় লোক টেলিগ্রাম করেছে কলকাতা থেকে, দার্জিলিং মেলের সময় এখানে খানা পাবে। তাদের জন্যে মাংসটা নিজে রাঁধবো। তারে তাই লেখা আছে।
দার্জিলিং মেলে চার-পাঁচটি বাবু নামিয়া হাজারির রেলওয়ে হোটেলে খাইতে আসিল। হাজারি নিজের হাতে মাংস রান্না করিয়াছিল। উহারা খাইয়া অত্যন্ত খুশী হইয়া গেল–হাজারিকে ডাকিয়া আলাপ করিল। উহাদের মধ্যে একজন বলিল–হাজারিবাবু, আপনার নাম কলকাতায় পৌঁচেছে জানেন তো? বড়ঘরে যারা পঞ্চাশ টাকা মাইনের ঠাকুর রাখে, তারা জানে রাণাঘাটের হিন্দু-হোটেলের হাজারি ঠাকুর খুব বড় রাঁধুনী। আমাদের সেইটে পরীক্ষা করে দেখবার জন্যে আজ আপনার এখানে আসা। তারে বলাও ছিল যাতে আপনি নিজে রাঁধেন। বড় খুশি হয়েছি খেয়ে।
.
ইহার কয়েক দিন পরে একখানা চিঠি আসিল কলিকাতা হইতে। সেদিন যাহারা রেলওয়ে হোটেলে খাইয়া গিয়াছিল তাহারা পুনরায় দেখা করিতে আসিতেছে আজ ওবেলা, বিশেষ জরুরী দরকার আছে। সাড়ে তিনটার কৃষ্ণনগর লোকালে দুইজন ভদ্রলোক নামিল। তাহাদের একজন সেদিনকার সেই লোকটি –যে হাজারির রান্নার অত সুখ্যাতি করিয়া গিয়াছিল। অন্য একজন বাঙালী নয়–কি জাত, হাজারি চিনিতে পারিল না।
পূর্বের ভদ্রলোকটি হাজারির সঙ্গে অবাঙালী ভদ্রলোকটির পরিচয় করাইয়া দিয়া হিন্দীতে বলিল–এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম। এই সে হাজারি ঠাকুর।