সেই রকম বড় বড় তেঁতুল গাছ ও অন্যান্য গাছের জঙ্গলে দিনমানেই এ পথে অন্ধকার। হাজারির মনে পড়িল সেবার যখন সে এ পথে গিয়াছিল, তখন রাণাঘাট হোটেলের চাকুরি তাহার সবে গিয়াছে–হাতে পয়সা নাই, পথ হাঁটিয়া এই পথে সে চাকুরি খুঁজিতে বাহির হইয়াছিল। আর আজ?
আজ অনেক তফাৎ হইয়া গিয়াছে। এখন সে রাণাঘাটের বাজারে দুটি বড় হোটেলের মালিক। তার অধীনে দশ-বারো জন লোক খাটে। যে মেয়েটির জন্য আজ তার এই উন্নতি, হাজারির সাধ্য নাই তাহার বিন্দুমাত্র প্রত্যুপকার সে করে–অতসী-মা বড়মানুষের মেয়ে, তার উপর সে বিবাহিতা–হাজারি তাহাকে কি দিতে পারে?
কিন্তু তাহার বদলে যে দুটি-একটি সরলা দরিদ্র মেয়ে তাহার সংস্পর্শে আসিয়াছে, সে তাহাদের ভাল করিবার চেষ্টা করিতে পারে। নতুন পাড়ার গোয়ালা-বউটি ইহাদের মধ্যে একজন। নতুন পাড়া পৌঁছিতে বেলা প্রায় ন’টা বাজিল। গ্রামের মধ্যে হঠাৎ না ঢুকিয়া হাজারি পথের ধারের একটা তেঁতুল গাছের ছায়ায় কাহাদের একখানা গরুর গাড়ী পড়িয়া আছে, তাহার উপর আসিয়া বসিল। সর্বাঙ্গে ঘাম, এক হাঁটু ধূলা–একটু জিয়াইয়া লইয়া ঘাম মরিলে সম্মুখের ক্ষুদ্র ডোবাটার জলে পা ধুইয়া জুতা পায়ে দিয়া ভদ্রলোক সাজিয়া গ্রামে ঢোকাই যুক্তিসঙ্গত।
একটি প্রৌঢ়বয়ষ্ক পথিক যশোরের দিক হইতে আসিতেছিল, হাজারিকে দেখিয়া সে কাছে গিয়া বলিল–দেশলাই আছে?
–আছে, বসুন।
–আপনারা?
–ব্রাহ্মণ।
–প্রণাম হই, একটু পায়ের ধূলো দেন ঠাকুরমশাই।
লোকটির নাম কৃষ্ণলাল, জাতিতে শাঁখারি, বাড়ী পূর্ববঙ্গ অঞ্চলে। কথাবার্তায় বেশ টান আছে পূর্ববঙ্গের। বনগ্রামে ইছামতীর ঘাটে তাহাদের শাঁখার বড় ভড় নোঙর করিয়া আছে, কৃষ্ণলাল পায়ে হাঁটিয়া এ অঞ্চলের গ্রামগুলি এবং ক্রেতার আনুমানিক সংখ্যা ইত্যাদি দেখিতে বাহির হইয়াছে।
কাজের লোক বেশীক্ষণ বসে না। একটা বিড়ি ধরাইয়া শেষ করিবার পূর্বেই কৃষ্ণলাল উঠিতে চাহিল। হাজারি কথাবার্তায় তাহাকে বসাইয়া রাখিল। বনগাঁ হইতে সতেরো মাইল পথ হাঁটিয়া ব্যবসার খোঁজ লইতে বাহির হইয়াছে যে লোক, তাহার উপর অসীম শ্রদ্ধা হইল হাজারির। ব্যবসা কি করিয়া করিতে হয় লোকটা জানে।
সে বলিল –গাঁজাটাজা চলে? আমার কাছে আছে—
কৃষ্ণলাল একগাল হাসিয়া বলিল–তা ঠাকুরমশায়–পেরসাদ যদি দেন দয়া করে–তবে তো ভাগ্যি।
–বোসো তবে, এক ছিলিম সাজি।
হাজারি খুব বেশী যে গাঁজা খায়, তা নয়। তবে উপযুক্ত সঙ্গী পাইলে এক-আধ ছিলিম খাইয়া থাকে। আজকাল রাণাঘাটে গাঁজা খাইবার সুবিধা নাই, হোটেলের সকলে খাতির করে, তাহার উপর নরেন আছে–এই সব কারণে হোটেলে ও ব্যাপার চলে না–বাসায় তো নয়ই, সেখানে টেঁপি আছে। আবার যাহার তাহার সঙ্গেও গাঁজা খাওয়া উচিত নয়, তাহাতে মান থাকে না। আজ উপযুক্ত সঙ্গী পাইয়া হাজারি হৃষ্টমনে ভাল করিয়া ছিলিম সাজিল। কলিকাটি ভদ্রতা করিয়া কৃষ্ণলালের হাতে দিতে যাইতেই কৃষ্ণলাল এক হাত জিভ কাটিয়া হাত জোড় করিয়া বলিল–বাপরে, আপনারা দেবতা। পেরসাদ করে দিন আগে–
কথায় কথায় হাজারি নিজের পরিচয় দিল। কৃষ্ণলাল খুশি হইল, সেও বাজে লোকের সঙ্গে মিশিতে ভালবাসে না–নিজের চেষ্টায় যে রাণাঘাটের বাজারে দুটি বড় বড় হোলেটের মালিক, তাহার সহিত বসিয়া গাঁজা খাওয়া যায় বটে।
হাজারি বলিল–রাণাঘাটে তো যাবে, আমার হোটেলেই উঠো। রেলবাজারে আমার নাম বললেই সবাই দেখিয়ে দেবে। পয়সা দিও না কিন্তু, আমি সই দিয়ে দিচ্ছি–তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
কৃষ্ণলাল পুনরায় হাতজোড় করিয়া বলিল–আজ্ঞে ওইটি মাপ করতে হবে কর্তা। আপনার হোটেলেই উঠবো–কিন্তু বিনি পয়সায় খেতে পারব না। ব্যবসার নিয়ম তা নয়, নেয্য নেবে, নেয্য দেবে। এ না হলে ব্যবসা চলে না। ও হুকুম করবেন না ঠাকুরমশায়।
–বেশ, তা যা ভাল বোঝো।
কৃষ্ণলাল পুনরায় পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বিদায় লইল।
.
হাজারি গ্রামের মধ্যে ঢুকিয়া শ্রীচরণ ঘোষের বাড়ী খুঁজিয়া বাহির করিল। শ্রীচরণ ঘোষ বাড়ীতেই ছিল, হাজারিকে দেখিয়া চিনিতে পারিল তখনই। এসব স্থানে কালেভদ্রে লোকজন আসে–কাজেই মানুষের মুখ মনে থাকে অনেক দিন।
বউটি সংবাদ পাইয়া ছুটিয়া আসিল। গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিয়া বলিল বলেছিলেন যে দু-মাসের মধ্যে আসবেন খুড়োমশায়? দু-বছর আড়াই বছর হয়ে গেল যে! মনে পড়ল এতদিন পরে মেয়ে বলে?
–তা তো পড়লো মা। এস সাবিত্রীসমান হও মা, বেশ ভাল আছ?
–আপনি যেরকম রেখেছেন। আপনাদের বাড়ীর সব ভাল খুড়োমশায়?
–তা এখন একরকম ভাল।
–কুসুমদিদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ভাল আছে?
–হ্যাঁ, ভাল আছে।
–আমার কথা বলেছিলেন?
হাজারি বিপদে পড়িল। ইহার এখান হইতে সেবার সেই যাইবার পরে গোপালনগরে চাকুরি করিল অনেক দিন, তারপর কতদিন পরে রাণাঘাটে গিয়া কুসুমের সহিত দেখা ইহার কথা তখন কি আর মনে ছিল?
–ইয়ে, ঠিক মনে পড়ছে না বলেছিলাম কিনা। নানা কাজে ব্যস্ত থাকি, সব সময় সব কথা মনে পড়ে না ছাই। বুড়োও তো হয়েছি মা–
–আহা বুড়ো হয়েছেন না আরও কিছু। আমার পিসেমশায়ের চেয়ে আপনি তো কত ছোট।
–কে গঙ্গাধর? হ্যাঁ, তা গঙ্গাধর আমার চেয়ে অন্ততঃ ষোল-সতেরো বছরের বড়।