–আজ ন-বছরের ওপর হ’ল। ওই একশ টাকা ছাড়া একটা পয়সা পাই নি-–কর্তা মশায় কেবলই বলে আসছেন একটু অবস্থা ভাল হোক হোটেলের–সব হবে, দেব।
–ওঁকে আগে থেকে জানতে নাকি, না রাণাঘাটে আলাপ?
–সে-সব অনেক কথা ঠাকুর। উনি আমাদের গাঁ ফুলে-নবলার চক্কত্তিদের বাড়ীর ছেলে। ওর বাবার নাম ছিল তারাচাঁদ চক্কত্তি–বড় ভাল লোক ছিলেন তিনি। অবস্থাও ভাল ছিল তার–আমাদের কর্তা হচ্ছেন তারাচাঁদ চক্কত্তির বড় ছেলে। লেখাপড়া তেমন শেখেন নি, বললেন রাণাঘাটে গিয়ে হোটেল করব, পদ্ম কিছু টাকা দিতে পার? দিলাম টাকা। সে আজ হয়ে গেল–
হাজারি ঠাকুরের মনে কৌতূহল জাগিলেও সে দেখিল আর অন্য কোনো প্রশ্ন পদ্মদিদিকে না করাই ভাল। গ্রামে এত লোক থাকিতে তারাচাঁদ চক্কত্তির বড় ছেলে তাহার কাছেই টাকা চাহিল কেন, সেই বা টাকা দিল কেন, রাণাঘাটে বেচুর হোটেলে তাহার ঝি-গিরি করা নিতান্ত দৈবাধীন যোগাযোগ না পূর্ব হইতেই অবলম্বিত ব্যবস্থার ফল–এসব কথা হাজারি জিজ্ঞাসা করিলে তাহাকে দোষ দেওয়া যাইত না।
কিন্তু হাজারির বয়স হইয়াছে, জীবনে তাহার অভিজ্ঞতা হইয়াছে কম নয়, সে এ-বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না করিয়া বলিল–হ্যাণ্ডনোটগুলো তুলে রেখে দাও পদ্মদিদি ভাল করে। সব ঠিক হয়ে যাবে, টাকাও তোমার হয়ে যাবে–এগুলো রেখে দাও।
পদ্ম ঝি রকম এক ধরনের হাসি হাসিয়া বলিল–ও সব তুলে রেখে কি করব ঠাকুর? ও সব কোন কালে তামাদি হয়ে ভূত হয়ে গিয়েছে। পড়ে দেখ না ঠাকুর–
হাজারি অপ্রতিভ হইয়া শুধু বলিল–ও!
–যা ছিল কিছু নেই ঠাকুর, সব হোটেলের পেছনে দিয়েছি–আর কি আছে এখন হাতে, ছাই বলতে রাইও না।
শেষের কথাগুলি পদ্মঝি যেন আপন মনেই বলিল, বিশেষ কাহাকেও উদ্দেশ করিয়া নহে। হাজারি অত্যন্ত দুঃখিত হইল। পদ্মঝির এমন অবস্থা সে কখনও দেখে নাই–ভিতরের কথা সে জানিত না, মিছামিছি কত রাগ করিয়াছে পদ্মদিদির উপর।
আরও কিছুক্ষণ বসিয়া হাজারি চলিয়া আসিল, সে কিছুই যখন করিতে পারিবে না আপাতত–তখন অপরের দুঃখের কাহিনী শুনিয়া লাভ কি?…
বাসায় ফিরিতেই সে এমন একটি দৃশ্য দেখিল যাহাতে সে একটি অদ্ভুত ধরনের আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করিল।
বাহিরের দিকে ছোট ঘরটার মধ্যে টেঁপির গলা। সে বলিতেছে–নরেনদা, চা না খেয়ে কিছুতেই আপনি এখন যেতে পারবেন না। বসুন।
নরেন বলিতেছে–না, এবার হোটেলে যেতে হবে, তুমি বোঝ না আশা, ইষ্টিশানের হোটেল এখন তো বন্ধ–কিন্তু মামাবাবু আসবার আগে এ-হোটেলের সব দেখাশুনো আমার করতে হবে।
টেঁপির ভাল নাম যে আশালতা, হাজারি নিজেই তা প্রায় ভুলিতে বসিয়াছে–নরেন ইতিমধ্যে কোথা হইতে তাহার সন্ধান পাইল!
টেঁপি পুনরায় আবদারের সুরে বলিল–না ওসব কাজটাজ থাকুক, আপনি আমাকে আর মাকে টকি দেখাতে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন–আজ নিয়ে যেতেই হবে।
–কি আছে আজ?
–আনব? একখানা টকির কাগজ রয়েছে ও ঘরে। ঢাক বাজিয়ে কাগজ বিলি করে যাচ্ছিল ওবেলা, খোকা একখানা এনেছে–
–যাও চট করে গিয়ে নিয়ে এস।
হাজারির ইচ্ছা ছিল না উহাদের কথাবার্তায় সে বাধা দেয়। এমন কি সে একপ্রকার নিঃশব্দেই রোয়াক পার হইয়া যেমন উত্তরের ঘরটার মধ্যে ঢুকিয়াছে, অমনি টেঁপি টকির কাগজের সন্ধানে আসিয়া একেবারে বাবার সামনে পড়িয়া গেল।
টেঁপি পাছে কোনপ্রকার লজ্জা পায়–এজন্য হাজারি অন্যদিকে চাহিয়া বলিল–এই যে টেঁপি। তোর মা কোথায়?
টেঁপি হঠাৎ যেন কেমন একটু জড়সড় হইয়া গেল। মুখে বলিল–কে, বাবা! কখন এলে? টের পাই নি তো?
হাজারির কিন্তু মনে হইল টেঁপি তাহাকে দেখিয়া খুব খুশি হয় নাই। যেন ভাবিতেছে, আর একটু পরে বাবা আসিলে ক্ষতিটা কি হইত।
হাজারি বুকের ভিতটা কোথায় যেন বেদনায় টনটন করিয়া উঠিল। মেয়েসন্তান, আহা বেচারী! সব কথা কি ওরা গুছিয়ে বলতে পারে, না নিজেরাই বুঝিতে পারে? টেঁপি কি জানে তার নিজের মনের খবর কি?
হাজারি বলিল–আমি এখুনি হোটেলে বেরিয়ে যাব টেঁপি। বেলা পাঁচটা বেজে গিয়েছে, আর থাকলে চলবে না। এক গ্লাস জল বরং আমায় দে–
ওঘর হইতে নরেন ডাকিয়া বলিল–মামাবাবু কখন এলেন?
হাজারি যেন পূর্বে নরেনের কথাবার্তা শুনতে পায় নাই বা এখানে নরেন উপস্থিত আছে বিষয়ে কিছু জানিত না, এমন ভাব দেখাইয়া বলিল–কে নরেন? কখন এলে বাবাজী?
–অনেকক্ষণ এসেছি মামাবাবু–চলুন, আমিও হোটেলে বেরিয়েছি—
বলিতে বলিতে নরেন সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
হানারি বলিল–একটু জলটল খেয়ে যাও না? হোটেলে এখন ধোঁয়ার মধ্যে গিয়েই বা করবে কি? বস বস বরং। টেঁপি তোর নরেনদা’র জন্য একটু চা–
–না না থাক মামাবাবু, হোটেলে তো চা এমনিই হবে এখন।
–তা হোক, আমার বাসায় যখন এসেছ, তখন এখান থেকেই চা খেয়ে যাও।
বলিয়া হাজারি বাড়ীর মধ্যের ঘরের দিকে সরিয়া গেল। টেঁপির মা তখনও রান্নাঘয়ের দাওয়ায় একখানা মাদুর বিছাইয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে দেখিতে পাইল। বেচারী চিরকাল খাটিয়াই মরিয়াছে এঁড়োশোলা গ্রামে–এখন চাকরে যখন প্রায় সব কাজই করিয়া দেয় তখন সে জীবনটাকে একটু উপভোগ করিয়া লইতে চায়।
হাজারি স্ত্রীকেও আগাইল না। সবাই মিলিয়া বড় কষ্ট করিয়াছে চিরকাল, এখন সুখের মুখ যখন দেখিতেছে–তখন সে তাহাতে বাদ সাধিবে না। টেঁপির মা ঘুমাইয়া থাকুক।