–তা বেশ বেশ, চলো না পদ্মদিদি।
ছোট্ট বাড়ীটা, একপাশে একটা পাতকুয়া, অন্যদিকে টিনের রান্নাঘর এবং গোয়াল। পদ্মঝি রোয়াকটাতে একখানা মাদূর আনিয়া হাজারির জন্য বিছাইয়া দিল। হাজারি খানিকটা অস্বস্তি ও আড়ষ্ট ভাব বোধ করিতেছিল। পদ্ম যে তাহার মনিব, তাহাদেরই হোটেলে সে একাদিক্রমে সাত বৎসর কাজ করিয়াছে, এ কথাটা এত সহজে কি ভোলা যায়? এমন কি, পদ্মঝিকে সে চিরকাল ভয় করিয়া আসিয়াছে, আজও যেন সেই ভাবটা কোথা হইতে আসিয়া জুটিল।
পদ্মঝি বলিল–পান সাজবো খাবে?
হাজারি আমতা আমতা করিয়া বলিল–তা–তা বরং একটা–
পান সাজিয়া একটা চায়ের পিরিচে আনিয়া হাজারির সামনে রাখিয়া বলিল–তারপর, রেলের হোটেল তো পেয়ে গেলে শুনলাম। ওখানে বসাবে কাকে?
–ওখানে বসাবো ভাবছি বংশীর ভাগ্নে সেই নরেন–নরেনকে মনে আছে? সেই তাকে।
–মাইনে কত দেবে?
–সে সব কথা এখনও ঠিক হয় নি। ও তো আমার এই হোটেলে খাতাপত্র রাখে, দেখাশুনো করে, বড় ভাল ছেলেটি।
–তা ভালো।
–চক্কত্তি মশায়ের শরীর ভাল আছে? ক’দিন ওদিকে আর যেতে পারি নি। হোটেল চলছে কেমন?
–হোটেল চলছে মন্দ নয়। তবে আমি কি বলচিলাম জানো ঠাকুর, কর্তামশায়কে রেলের হোটেলে একটা অংশ দিয়ে রাখো না তুমি? তোমার কাজের সুবিধে হবে।
হাজারি এ প্রস্তাবের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। একটু বিস্ময়ের সুরে বলিল–কৰ্ত্তা কি করে থাকবেন? ওঁর নিজের হোটেল?
–সেজন্যে ভাবনা হবে না। সে আমি দেখব। কি বল তুমি?
–এখন আমি কোন কথা দিতে পারব না পদ্মদিদি। তবে একটা কথা আমার মনে হচ্ছে তা বলি। রেল-কোম্পানী যখন টেণ্ডার নেয়, তখন যার নাম লেখা থাকে, তার ছাড়া আর কোন লোকের অংশটংশ থাকতে দেবে না হোটেলে। হোটেল ত আমার নয়–হোটেল রেল-কোম্পানীর।
–ঠাকুর একটা কথা বলব? তুমি এখন বড় হোটেলওয়ালা, অনেক পয়সা রোজগার কর শুনি। কিন্তু আমি তোমায় সেই হাজারি ঠাকুরই দেখি। তুমি এস আমাদের হোটেলে আবার।
হাজারি বিস্ময়ের সুরে বলিল–চক্কত্তি মশায়ের হোটেলে? রাঁধতে?
সে মনে মনে ভাবিল–পদ্মদিদির মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? বলে কি?
পদ্ম ঝিন্তু বেশ দৃঢ় স্বরেই বলিল–সত্যি বলচি ঠাকুর। এস আমাদের ওখানে আবার।
–কেন বল তো পদ্মদিদি? একথা তুললে কেন?
–তবে বলি শোন। তুমি এলে আমাদের হোটেলটা আবার জাঁকবে।
এমন ধরনের কথা হাজারি কখনও পদ্মঝিয়ের মুখে শোনে নাই। সেই পদ্মঝি আজ কি কথা বলিতেছে তাহাকে?
হাজারি গলিয়া গেল। সে ভুলিয়া গেল যে সে একজন বড় হোটেলের মালিক –পদ্মদিদি তাহার মনিবের দরের লোক, তাহার মুখের একথা যেন হাজারির জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এই আশায় যেন সে এতদিন রাণাঘাটের রেলবাজারে এত কষ্ট করিয়াছে।
অন্য লোকে হাজার ভাল বলুক, পদ্মদিদির ভাল বলা তাদের চেয়ে অনেক উঁচু, অনেক বেশ মূল্যবান।
কিন্তু পদ্ম যাহা বলিতেছে, তাহা যে হয় না একথা সে পদ্মকে কি করিয়া বুঝাইবে! যখন সে গোপালনগরের চাকুরি ছাড়িয়া পুনরায় চক্কত্তি মশায়ের হোটেলে চাকুরি লইয়াছিল– তখনও উহারা যদি তাহাকে না তাড়াইয়া দিত, তবে তো নিজ হোটেল খুলিবার কল্পনাও তাহার মনে আসিত না। উহাদের হোটেলে পুনরায় চাকুরি পাইয়া সে মহা সৌভাগ্যবান মনে করিয়াছিল নিজেকে–কেন তাহাকে উহারা তাড়াইল।
এখন আর হয় না।
এখন সে নিজের মালিক নয়, কুসুমের টাকা ও অতসীমা’র টাকা হোটেলে খাটিতেছে, তাহার উন্নতি-অবনতির সঙ্গে অনেকগুলি প্রাণীর উন্নতি-অবনতি জড়ানো। নিজের খেয়াল খুশিতে যা-তা করা এখন আর চলিবে না।
টেঁপির ভবিষৎ দেখিতে হইবে–টেঁপি আর নরেন।
অনেক দূর আগাইয়া আসিয়াছে–আর এখন পিছানো চলে না।
হাজারি পদ্মঝিয়ের মুখের দিকে দুঃখ ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল–
–আমার ইচ্ছে করে পদ্মদিদি। কিন্তু এখন যাওয়া হয় কি করে তুমিই বল।
পদ্ম যে কথাটা না বোঝে তা নয়, সে নিতান্ত মরীয়া হইয়াই কথাটা বলিয়া ফেলিয়াছিল। হাজারির কথার সে কোনো জবাব না দিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিল এবং কিছুক্ষণ পরে একটা কাপড়-জড়ানো ছোট্ট পুঁটুলি আনিয়া হাজারির সামনে রাখিয়া বলিল–পড়তে চান তো, পড়ে দেখ না?
হাজারি পড়িতে জানে না তাহা নয়, তবে ও কাজে সে খুব পারদর্শী নয়। তবু পদ্মদিদির সম্মুখে সে কি করিয়া বলে যে সে ভাল পড়িতে পারে না! পুঁটুলি খুলিয়া সে দেখিল খান কয়েক কাগজ ছাড়া তার মধ্যে আর কিছু নাই।
পদ্মঝি তাহাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিল। সে নিজেই বলিল–ক-খানা হ্যাণ্ডনোট, তা সবসুদ্ধ সাতশ টাকার হ্যাণ্ডনোট। কর্তাকে আমি টাকা দেই যখনই দরকার হয়েছে তখন। নিজের হাতের চুড়ি বিক্রি করি, কানের মাকড়ি বিক্রি করি–ছিল তো সব, যখন এইস্তিরি ছিলাম, দুখানা সোনাদানা ছিল তো অঙ্গে।
হাজারি বিস্মিত হইয়া বলিল–তুমি টাকা দিয়েছিলে পদ্মদিদি?
–দেই নি তো কার টাকায় হোটেল চলছিল এতদিন? যা কিছু ছিল সব ওর পেছনে খুইয়েছি।
–কিছু টাকা পাও নি?
–পেটে খেয়েছি আমি, আমার বোনঝি, আমার এক দেওর-পো এই পর্যন্ত। পয়সা যে একেবারে পাই নি তা নয়–তবে কত আর হবে তা? বোনঝির বিয়েতে কর্তা-মশায় একশ টাকা দিয়েছিলেন–সে আজ সাত বছরের আগের কথা। সাতশ টাকার সুদ ধর কত হয়?
–টাকা অনেক দিন দিয়েছিলে?