হাজারি ঠাকুর কথাটা বলিয়াছিল বটে তবে সে দই পচা কি তাজা তাহা বলে নাই বলিয়াছিল ব্যাপারী খদ্দেররা বলাবলি করিতেছিল এ রকম খারাপ দই খাইতে দিলে তাহারা চোদ্দ পয়সার জায়গায় বারো পয়সার বেশি খোরাকি দিবে না।
পদ্ম ঝি রান্নাঘরের চৌকাঠে পা দিয়া ঝাঁজালো ঝগড়ার সুরে বলিল–বলি, ও ঠাকুর দই পচা তোমাকে কে বলেছে?
হাজারি আমতা আমতা করিয়া বলিল–ওই সাধু মণ্ডল আর তার ভাইপো রোজ হাটেই তো এখানে খায়–ওরাই বলচিল–
–বলচিল! তোমার গলা ধরে বলতে গিয়েছে ওরা। তোমার মত হিংসুক কুচুটে লোক তো কখনো দেখিনি–আমি দই দিই বলে তুমি হিংসেয় বুক ফেটে মরে যাচ্চ সে কি আমি বুঝিনে! তোমার শখের কুসুম গয়লানীর ছাপ-বাক্সে পয়সা না উঠলে কি আর তোমার মনে শান্তি আছে!…গাঁজাখোর মড়ুই-পোড়া বামুন কোথাকার!
হাজারি জিভ কাটিয়া বলিল–ছি ছি, কি যে বলো পদ্মদিদি তার ঠিক নেই–-কুসুমের বাপের বাড়ী আমাদের গায়ে, আমায় জ্যাঠা ব’লে ডাকে, আমি তাকে মেয়ে বলি–তার নামে অমন কথা বল্লে তোমার পাপ হবে না?
ইহার উত্তরে পদ্ম ঝি যাহা বলিল, তাহা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করা যায় না।
হাজারির চোখে প্রায় জল আসিল। কুসুমকে সে সত্যই মেয়ের মত স্নেহ করে– তাহাদের গ্রামের রসিকলাল ঘোষের মেয়ে–রাণাঘাটে তার শশুরবাড়ী–অল্পবয়সে বিধবা হইয়াছে, এখন দুধ বেচিয়া, দই বেচিয়া ছোট ছোট দুইটি ছেলেকে মানুষ করে। এক শাশুড়ী ছাড়া বাড়ীতে কেহ নাই।
হঠাৎ একদিন পথে দু’জনের দেখা।
–জ্যাঠামশায় যে! দাঁড়ান একটু পায়ের ধূলো দিন। আপনি এখানে কোথায়?
–আরে কুসুম, কোত্থেকে তুই এখানে?
–এই তো আমার শশুরবাড়ী, ছোট বাজারে মন্দিরের গায়েই। আপনি কি আজ বাড়ী থেকে এসেছেন?
–না রে–আমি রেল-বাজারে হোটেলে কাজ করি। আজ মাস ছ’-সাত আছি।
বিদেশে একই গ্রামের মানুষ দেখিয়া দু’জনেই খুব খুশী হইল। সেই হইতে কুসুম হাজারি ঠাকুরের হোটেলে দুধ দই বেচিতে গিয়াছে। গরীব বলিয়া হাজারি ঠাকুর অনেকবার লুকাইয়া হোটেল হইতে রাঁধা ভাত-তরকারি তাহাকে থালা করিয়া বাড়িয়া দিয়াছে। দুধ দই বেচিয়া ফিরিবার সময় কুণ্ডুদের পাটের আড়তের গলিটায় দাঁড়াইয়া কুসুম থালা লইয়া গিয়াছে। ইহাদের মেলামেশা ও ঘনিষ্ঠতা পদ্ম ঝির চোখ এড়ায় নাই, সুতরাং সে বলিতেই পারে।
.
দুপুরের পর হাজারি প্রতিদিনের মত চূর্ণীর ধারে যাইতেছে–এমন সময় কুসুমের সঙ্গে দেখা হইল।
কুসুম দুধের ভাঁড় হাতে ঝুলাইয়া বাড়ী ফিরিতেছিল। তাহার বয়স চব্বিশ-পঁচিশ, বেশ স্বাস্থ্য, রং শ্যামবর্ণ, মুখশ্রী বেশ শান্ত।
হাজারি বলিল–বাড়ী ফিরছিস এত বেলায় যে!
কুসুম বলিল–জ্যাঠামশায়, বড্ড দেরি হয়ে গেল। নিজের তো দুধ নেই–কায়েত পাড়া থেকে দুধ আনি, তবে বিক্রী করি, তবে বাড়ী ফিরি। আসুন না আমাদের বাড়ী।
–না, এখন আর কোথায় যাবো! তুই যা, খাবি-দাবি।
কুসুম কিছুতেই ছাড়ে না, বলিল–আমার খাওয়া-দাওয়া জ্যাঠামশায়, শাশুড়ী রেঁধে রেখে দিয়েচে গিয়ে খাবো; কতক্ষণ লাগবে? আসুন না।
হাজারি অগত্যা গেল। ছ’চাল একখানা বড় ঘর, সেখানেতে কুসুমের শাশুড়ী থাকে আর একখানা ছোট চারচালা ঘরে কুসুম ছেলে দুটি লইয়া থাকে। শাশুড়ীর সহিত কুসুমের খুব সদ্ভাব নাই।
কুসুম নিজের ঘরে হাজারিকে লইয়া গিয়া বসাইল। ঘরের মধ্যে একখানা তক্তপোশ, পুরু কাঁথা পাতিয়া সুন্দর পরিপাটি বিছানা তাহার উপরে। তক্তপোশের নীচে বালি দেওয়া আর-বছরের আলু। এককোণে কতকগুলি হাঁড়িকুড়ি ও একটা বড় জালা–বাঁশের আলনাতে কতকগুলি লেপ-কাঁথা বাঁধা। একটা জলচৌকিতে থানকতক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে পিতল কাঁসার বাসন। ঘর দেখিয়া হাজারির মনে হইল–কুসুম বেশ সাজাইয়া রাখিতে জানে জিনিসপত্র।
কুসুম বলিল–পান খাবেন জ্যাঠামশায়?
–দে একটা। আর তুই খেতে যা। বেলা অনেক হয়েচে।
কিন্তু কুসুমের দেখা গেল, খাওয়ার সম্বন্ধে কোনো তাড়া নাই। হাজারিকে পান দিয়া সেই যে হাজারির সামনে মেজেতে বসিয়া গল্প করিতে লাগিল–প্রায় ঘণ্টাখানেক হইয়া গেল। সে নড়িবার নামও করে না দেখিয়া হাজারি ব্যস্ত হইয়া পড়িল।
বলিল–তুই খেতে যা না। আমি যাই, আবার উনুনে আঁচ দিতে হবে সকাল সকাল।
কুসুম বলিল–যাচ্ছি এবার।
বলিয়া আর যায় না। আরও আধঘণ্টা কাটিয়া গেল।
কুসুম আর যায় নাই। বাবা মারা গিয়াছে, ভাইয়েরা গরীব বলিয়া হউক বা ভাইবৌদের জন্যই হউক–তাহাকে বাপের বাড়ীতে কেহ লইয়া যায় না। নিজে দু-একবার গিয়াছিল, বেশী দিন টিকিতে পারে নাই। ভাইবৌদের ব্যবহার ভাল নয়।
হাজারির সঙ্গে কুসুম সেই সব কাহিনীই বলিতে লাগিল। ছেলেবেলায় গ্রামে কি পথে করিয়াছিল কি, সেই বিষয়ে কথাও তাহার আর ফুরায় না।
–এখানে ছোলার শাক পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। আমাদের গাঁয়ের যুগীপাড়ার মাঠে আমরা ছোলার শাক তুলতে যেতাম জ্যাঠামশায়–একবার, তখন আমার বয়েস ন’বছর, আমি আর সাধু কুমোরের মেয়ে আদর, আমরা দুজনে গিয়েছি ছোলার শাক তুলতে– একটা মিন্সে দেখি জ্যাঠামশায় ছোলার ক্ষেতে বসে কচি ছোলা তুলে তুলে খাচ্ছে। আমাদের দেখে দোড় দোড়, বিষম দোড়! আমরা তো হেসে বাচিনে–ভেবেছে বুঝি আমাদের ক্ষেত!
বলিয়া কুসুম মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে হাসিতে গড়াইয়া পড়ে আর কি!