বেচু ও পদ্মঝি দু’জনেই বিস্ময়ে অস্ফুট চীৎকার করিয়া উঠিল প্রায়।
বেচু চক্কত্তি বলিল–দেখে এলেন?
–নিজের চোখে। ছাপা অক্ষরে। নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দিয়েছে–
পদ্মঝি হতবাক হইয়া যদু বাঁড়ুয্যের দিকে চাহিয়া রহিল, বোধ হইল কথাটা যেন সে এখনও বিশ্বাস করে নাই।
বেচু চক্কত্তি বলিল–তা হলে ওরই হল!
এ কথার কোন অর্থ নাই, যদুও বুঝিল, পদ্মঝিও বুঝিল। ইহা শুধু বেচুর মনের গভীর নৈরাশ্য ও ঈর্ষার অভিব্যক্তি মাত্র।
যদু বাঁড়ুয্যে বলিল–ওঃ, লোকটার বরাত খুবই ভাল যাচ্ছে দেখছি। ধূলো মুঠো ধরলে সোনা মুঠো হচ্ছে। আজ একুশ বছর এই রেলবাজারে হোটেল চালাচ্ছি, আমরা গেলাম ভেসে, আর ও হাতাবেড়ি ঠেলে আপনার হোটেলে পেট চালাত, তার কিনা–সবই বরাত–
বেচু বলিল–কেন হল, কিছু শুনলেন নাকি? টাকা ঘুষ দিয়েছিল নিশ্চয়–
–টাকার ব্যাপার নেই এর মধ্যে। হেড অফিসের বোর্ড থেকে নাকি মঞ্জুর করেছে– এখানকার ইষ্টিশান মাষ্টার সাহেব নাকি ওর পক্ষে খুব লিখেছিল। কোন কোন প্যাসেঞ্জার ওর নাম লিখেছে হেড অফিসে, খুব ভাল রান্না করে নাকি, এই সব।
আর কিছুক্ষণ থাকিয়া যদু চলিয়া গেলে পদ্মঝি বলিল–বলি এ কি হল, হ্যাঁ কর্তা?
–তাই তো!
–মড়ুই পোড়া বামুনটা বড় বড় বাড়িয়েচে, আর তো সহ্যি হয় না—
–কি আর করবে বল। আমি ভাবছি
–কি?
–কাল একবার হাজারির হোটেলে আমি যাই
–কেন, কি দুঃখে?
–ওকে বলি আমার হোটেলে তুমি অংশীদার হও, ছেলের হোটেলের অংশ কিছু আমায় দাও–
পদ্মঝি ভাবিয়া বলিল–কথাটা মন্দ নয়। কিন্তু যদি তোমায় না দিতে চায়?
–আমাকে খুব মানে কিনা তাই বলচি। এ না করলে আর উপায় নেই পদ্ম। হোটেল আর চালাতে পারবো না। একরাশ দেনা–খরচে আছে আর কুলোয় না। এ আমায় করতেই হবে।
পদ্মঝিয়ের মুখে বেদনার চিহ্ন পরিস্ফুট হইল। বলিল–যা ভাল বোঝ কর কর্তা। আমি কি বলব বল!
কিছুক্ষণ পরে যদু বাঁড়ুয্যে পুনরায় বেচুর হোটেলে আসিয়া বসিল। বেচু চক্কত্তি খাতির করিয়া তাহাকে চা খাওয়াইল। তামাক সাজিয়া হাতে দিল।
তামাক টানিতে টানিতে যদু বলিল–একটা মতলব মনে এসেছে চক্কত্তি মশায়–তাই আবার এলাম।
বেচু সকৌতূহলে বলিল–কি বলুন তো?
–আমি পালচৌধুরীদের নায়েব মহেন্দ্রবাবুকে ধরেছিলাম। ওঁরা জমিদার, ওঁদের খাতির করে রেল কোম্পানী। মহেন্দ্রবাবুর চিঠি নিয়ে কাল চলুন, আপনি আর আমি কলকাতা রেল আপিসে একবার আপীল করি গিয়ে।
পদ্মঝি দোরের কাছেই ছিল, সে বলিল–তাই যান গিয়ে কর্তা, আমিও বলি যাতে কক্ষনো ও মডুই পোড়া বামুন হোটেল না পায় তা করাই চাই, দু’জনে তাই যান–
বেচু চক্কত্তি ভাবিয়া বলিল–কখন যেতে চান কাল?
যদু বলিল–কাল সকাল যাওয়াই ভাল। বড় বাবুকে ধরতে হবে গিয়ে–পালচৌধুরীদের পুকুরে মাছ ধরতে আসেন প্রায়ই। গরফেতে বাড়ী, বড় ভাল লোক। মহেন্দ্রবাবুর চিঠি নিয়ে গিয়ে ধরি।
যদু চলিয়া গেলে বেচু চক্কত্তি পদ্মকে বলিল–কিন্তু তাহলে হাজারির কাছে আমার ওভাবে যাওয়া হয় না। ও সব টের পাবেই যে আমরা আপীল করেছি, ওকেও নোটিশ দেবে কোম্পানী। আপীলের শুনানী হবে। তারপর কি আর ওর কাছে যাওয়া যায়?
–না হয় না গেলে। ওর দরকার নেই, যাতে ওর উচ্ছেদ হয় তাই কর।
–বেশ, যা বল।
পরদিন যদু বাঁড়ুয্যের সঙ্গে বেচু চক্কত্তি কয়লাঘাটে রেলের বড় আপিসে যাইবে বলিয়া বাহির হইল এবং সন্ধ্যার পরে পুনরায় রাণাঘাটে ফিরিল। বেচু যখন নিজের হোটেলে ঢুকিল, তখন খাওয়াদাওয়া আরম্ভ হইয়াছে। পদ্মঝি ব্যস্তভাবে বলিল–কি হল কর্তা।
বেচু বলিল–আর কি, মিথ্যে যাতায়াত সার হল, দুটো টাকা বেরিয়ে গেল। তারা বল্লে–এ, আমাদের হাতে নেই, টেণ্ডার মঞ্জুর হয়ে বোর্ডের কাছে চলে গিয়েছে। এখন আর আপীল খাটবে না।
–তবে যাও কাল হাজারির কাছেই যাও–
তার দরকার নেই। বাঁড়ুয্যে মশায় আসবার সময় বল্লেন–ওঁর হোটেল আর আমার হোটেল একসঙ্গে মিলিয়ে দিতে। এ ঘর ছেড়ে দিয়ে সামনের মাসে ওঁর ঘরেই–
পদ্মঝি বলিল–এ কিন্তু খুব ভাল কথা। ও ছোটলোকটার কাছে না গিয়ে বাঁড়ুয্যে মশায়ের সঙ্গে কাজ করা ঢের ভাল।
.
পরবর্তী পনেরো দিনের মধ্যে রাণাঘাট রেলবাজারে দুইটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটিয়া গেল।
স্টেশনের আপ, প্ল্যাটফর্মে নূতন হিন্দু-হোটেল খোলা হইল। শ্বেতপাথরের টেবিল, চেয়ার, ইলেকট্রিক আলো, পাখা দিয়া সাজানো আধুনিক ধরনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অতি চমৎকার হোটেলটি। হোটেলের মালিকের স্থানে হাজারির নাম দেখিয়া অনেকে আশ্চর্য হইয়া গেল।
আর একটি বিশিষ্ট ঘটনা, বেচু চক্কত্তির পুরানো হোটেলটি উঠিয়া যাইবে এমন একটা গুজব রেলবাজারের সর্বত্র রটিল।
সেদিন বিকালের দিকে হাজারি তাহার পুরানো অভ্যাসমত চূর্ণীর ধার হইতে বেড়াইয়া ফিরিতেছে, এমন সময় পদ্মঝিয়ের সঙ্গে রাস্তায় দেখা।
হাজারিই পদ্মকে ডাকিয়া বলিল–ও পদ্মদিদি, কোথায় যাচ্ছ?
পদ্মঝি দাঁড়াইল। তাহার হাতে একটা ছোট্ট পাথরের বাটি। সম্ভবত কাছেই কোথাও পদ্মঝিয়ের বাসা।
হাজারি বলিল–বাটিতে কি পদ্মদিদি?
-একটু দম্বল, দই পাতবো বলে গোয়ালাবাড়ী থেকে নিয়ে যাচ্ছি।
–তারপর, ভাল আছ?
–তা মন্দ নয়। তুমি ভাল আছি ঠাকুর।
এখানে কাছেই থাকো বুঝি?
এ কথার উত্তরে পদ্মঝি যাহা বলিল হাজারি তাহার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না। বলিল– এস না ঠাকুর, আমার বাড়ীতে একবার এলেই না হয়–