বেচু বলিল–টেণ্ডারের দরখাস্ত দিতে গেলে এখুনি পাঁচটা টাকা চাই, তবিলে আছে দেখছি এক টাকা সাড়ে তের আনা মোট, ওবেলার দরুন। তার মধ্যে কয়লার দাম দেবো বলা আছে ওবেলা, কয়লাওয়ালা এল বলে। টাকা কোথায়?
পদ্মঝি একটু ভাবিয়া বলিল–ও-থেকে একটা টাকা নাও এখন। আর আমি চার টাকা যোগাড় করে এনে দিচ্ছি। আমার লবঙ্গফুল থাকে এপাড়ায় তার কাছ থেকে। কয়লা-ওয়ালাকে আমি বুঝিয়ে বলবো–
–বুঝিয়ে রাখবে কি, সে টাকা না পেলে কয়লা বন্ধ করবে বলেছে। তুমি পাঁচ টাকাই এনে দ্যাও–
সন্ধ্যার পূর্কে বেচুও গিয়া টেণ্ডার দিয়া আসিল। পদ্মঝি সাগ্রহে গদির ঘরের দ্বারে অপেক্ষা করিতেছিল, এখনও খরিদ্দার আসা শুরু হয় নাই। বলিল–হয়ে গেল কর্তা? কি শুনে এলে?
–হয়ে যাবে এখন? ছেলের হাতের পিঠে বুঝি? তবে খুব লাভের কাণ্ড যা শুনে এলাম। যদু পাকা লোক–নইলে কি দরখাস্ত দেয়? আমি আগে বুঝতে পারি নি। মোটা লাভের ব্যবসা। ইস্টিশানের ক্ষেত্রবাবু আমার এখানে খেতো মনে আছে? সে আবার বদলি হয়ে এসেছে এখানে। সে-ই বল্লে–যাত্রীরা রেলের বড় আপিসে দরখাস্ত করেছে আমাদের খাওয়ার কষ্ট। তা ছাড়া, রেল কোম্পানী এলেটিক আলো দেবে, পাখা দেবে, ঘর করে দেবে–তার দরুন কিছু নেবে না আপাতোক। রেলের বোর্ড না কি আছে, তাদের অর্ডার। যাত্রীদের সুবিধে আগে করে দিতে হবে। যথেষ্ট লোক খাবে পদ্ম, মোটা পয়সার কাণ্ড যা বুঝে এলাম।
পদ্মঝি বলিল–জোড়া পাঁঠা দিয়ে পুজো দেবো সিদ্ধেশ্বরীতলায়। হয়ে যেন যায়–তুমি কাল আর একবার গিয়ে ওদিগের কিছু খাইয়ে এসো—
–বলি যদু বাঁড়ুয্যে টের পেলে কি করে হ্যাঁ?
–ও সব ঘুঘু লোক। ওদের কথা ছাড়ান দ্যাও।
ক্রমে এ সম্বন্ধে অনেক রকম কথা শোনা গেল। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখা গেল রেলের তরফ হইতে একটি চমৎকার ঘর তৈয়ারী করিতেছে–আসবাবপত্র, আলমারি, টেবিল, চেয়ার দিয়া সেটি সাজানো হইবে, সে-সব কোম্পানী দিবে।
এই সময় একদিন যদু বাঁড়ুয্যেকে হঠাৎ তাহাদের গদিঘরে আসিতে দেখিয়া বেচু ও পদ্মঝি উভয়েই আশ্চর্য হইয়া গেল। যদু বাঁড়ুয্যে হোটেলওয়ালাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি–কুলীন ব্রাহ্মণ, মাটিঘরার বিখ্যাত বাঁড়ুয্যে-বংশের ছেলে। কখনও সে কারো দোকানে বা হোটেলে গিয়া হাউ-হাউ করিয়া বকে না–গম্ভীর মেজাজের মানুষটি।
বেচু চক্কত্তি যথেষ্ট খাতির করিয়া বসাইল। তামাক সাজিয়া হাতে দিল।
যদু বাঁড়ুয্যে কিছুক্ষণ তামাক টানিয়া একমুখ ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল–তারপর এসেছি একটা কাজে, চক্কত্তি মশায়। হোটেল চলছে কেমন?
বেচু বলিল–আর তেমন নেই, বাঁড়ুয্যে মশায়। ভাবছি, তুলে দিয়ে আর কোথায়ও যাই! খদ্দেরপত্তর নেই আর–
–আপনার কাছে আমার আসার উদ্দেশ্য বলি। ইস্টিশানে হোটেল হচ্ছে জানেন নিশ্চয়ই। আমি একটা টেণ্ডার দিই। শুনলাম আপনিও নাকি দিয়েছেন?
–হ্যাঁ—তা—আমিও—
–বেশ। বলি, শুনুন। নৈহাটির একজন ভাটিয়া নাকি বড্ড তদ্বির করচে ওপরে–তাই হয়ে যাবে। মোটা পয়সার কারবার হবে ওই হোটেলটা। আসাম মেল, শান্তিপুর, বনগাঁ, ডাউন চাটগাঁ মেল–এসব প্যাসেঞ্জার খাবে–তা ছাড়া থাউকো লোক খাবে। ভাল পয়সা হবে এতে। আষন আপনি আর আমি দু’জনে মিলে দরখাস্ত দিই যে রাণাঘাটের আমরা স্থানীয় হোটেলওয়ালা, আমাদের ছেড়ে ভাটিয়াকে কেন দেওয়া হবে হোটেল। স্থানীয় হোটেলওয়ালারা মিলে একসঙ্গে দরখাস্ত করেছে এতে জোর দাঁড়াবে আমাদের খুব।
বেচু বুঝিল নিতান্ত হাতের মুঠার বাহিরে চলিয়া যায় বলিয়াই আজ ষদু বাঁড়ুয্যে তাহার গদিতে ছুটিয়া আসিয়াছে–নতুবা ঘুঘু যদু কখনও লাভের ভাগাভাগিতে রাজী হইবার পাত্র নয়। বলিল–বেশ দরখাস্ত লিখিয়ে আনুন–আমি সই করে দেবো এখন।
যদু বাঁড়ুয্যে পকেট হইতে একখানা কাগজ বাহির করিয়া বলিল–আরে, সে কি বাকি আছে, সে অশ্বিনী উকীলকে দিয়ে মুসোবিদে করে টাইপ করিয়ে ঠিক করে এনেছি। আপনি এখানটায় সই করুন–
যদু বাঁড়ুয্যে সই লইয়া চলিয়া গেলে পদ্মঝি আসিয়া বলিল–কি গা কর্তা?
বেচু হাসিয়া বলল–কারে না পড়লে কি ঘুঘু যদু বাঁড়ুয্যে এখানে আসে কখনো? সেই হোটেল নিয়ে এসেছিল। শুনবে?
পদ্ম সব শুনিয়া বলিল–তাও ভালো। বেশী যদি বিক্রী হয়, ভাগাভাগিও ভালো। এখানে তোমার চলবেই না, যেরকম দাঁড়াচ্চে তার আর কি। হোক ইষ্টিশানে আধা বখরাই হোক।
দিন কুড়ি-বাইশ পরে একদিন যদু বাঁড়ুয্যে বেচুর গদিঘরে ঢুকিয়া যে ভাবে ধপ করিয়া হতাশ ভাবে তক্তপোশের এক কোণে বসিয়া পড়িল, তাহাতে পদ্মঝি (সেখানেই ছিল) বুঝিল স্টেশনের হোটেল হাতছাড়া হইয়া গিয়াছে।
কিন্তু পরবর্তী সংবাদের জন্য পদ্মঝি প্রস্তুত ছিল না।
যদু বলিল–শুনেছেন, চক্কত্তি মশাই! কাণ্ডটা শোনেন নি?
বেচু চক্কত্তি ওভাবে যদু বাঁড়ুয্যেকে বসিতে দেখিয়া পূর্বেই বুঝিয়াছিল সংবাদ শুভ নয়। তবুও সে ব্যস্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করিল–কি। কি ব্যাপার?
–ইষ্টিশানের থেকে আসছি এই মাত্তর, আজ ওদের হেড অফিস থেকে টেণ্ডার মঞ্জুর করে নোটিশ পাঠিয়েছে–
বেচু একথার উত্তরে কিছু না বলিয়া উদ্বিগ্ন মুখে যদু বাঁড়ুয্যের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
–কার হয়ে গেল জানেন?
–না–সেই ভাটিয়া ব্যাটার বুঝি
–তা হলেও তো ছিল ভাল। হল হাজারির, তোমাদের হাজারি—