বেচু চক্কত্তি অপ্রসন্ন মুখে বলিলেন–মোট ছ’টাকা সাড়ে তিন আনা–
পদ্মঝি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বলিল–দু’মাসের বাড়ীভাড়া বাকী ওদিকে। কাল বলেছে অন্ততঃ একমাসের ভাড়া না দিলে হৈ চৈ বাধাবে। ভাড়া দেবে কোত্থেকে?
–দেখি।
–তারপর কানাই ঠাকুরের মাইনে বাকী পাঁচ মাস। সে বলছে আর কাজ করবে না, তার কি করি?
–বুঝিয়ে রাখো এই মাসটা। দেখি সামনের মাসে কি রকম হয়—
পদ্মঝি রান্নাঘরে গিয়া ঠাকুরকে বলিল–আমার ভাতটা বেড়ে দাও ঠাকুর, রাত হয়েছে অনেক, বাড়ী যাই।
তারপর সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। ছন্নছাড়া অবস্থা, ওই বড় দশ সেবী ডেকচিটা আজ তিন-চার মাস তোলা আছে–দরকার হয় না। আগে পিতলের বালতি করিয়া সরিষার তৈল আসিত, এখন আসে ছোট ভাঁড়ে–বালতি দরকার হয় না। এমন দুরবস্থা সে কখনো দেখে নাই হোটেলের।
তাহার মনটা কেমন করিয়া ওঠে।…
নানারকমে চেষ্টা করিয়া এই হোটেলটা সে আর কর্তা দুজনে গড়িয়া তুলিয়া ছিল। এই হোটেলের দৌলতে যথেষ্ট একদিন হইয়াছে। ফুলেনবলা গ্রামের যে পাড়ায় তাহার আদি বাস ছিল, সেখানে তার ভাই এখনও আছে– চাষবাস করিয়া খায়–আর সে এই রাণাঘাটের শহরে সোনাদানাও পরিয়া বেড়াইয়াছে একদিন–এই হোটেলের দৌলতে। এই হোটেল তার বুকের পাঁজর। কিন্তু আজ বড় মুশকিলের মধ্যে পড়িতে হইয়াছে। কোথা হইতে এক উনপাঁজুরে গাঁজাখোর আসিয়া জুটিল হোটেলে–হোটেলের সুলুকসন্ধান জানিয়া লইয়া এখন তাহাদেরই শীলনোড়ায় তাহাদেরই দাঁতের গোড়া ভাঙিতেছে। এত যত্নের, এত সাধ-আশার জিনিসটা আজ কোথা হইতে কোথায় দাঁড়াইয়াছে! যাহার জন্য আজ হোটেলের এই দুরবস্থা,–ইচ্ছা হয় সেই কুকুরটার গলা টিপিয়া মারে, যদি বাগে পায়। তাহার উপর আবার দয়া কিসের? কর্তা ওই রকম ভালমানুষ সদাশিব লোক বলিয়াই তো আজ পথের কুকুর সব মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছে।—দয়া!
.
একদিন রাণাঘাটের স্টেশন মাস্টার হাজারিকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।
হাজারি নিজে যাইতে রাজী নয়–কারণ স্টেশন মাস্টার সাহেব, সে জানে। নরেন যাওয়াই ভাল। অবশেষে তাহাকেই যাইতে হইল। নরেন সঙ্গে গেল।
সাহেব বলিলেন–টোমার নাম হাজারি? হিণ্ডু হোটেল রাখো বাজারে?
-হ্যাঁ হুজুর।
–টুমি প্ল্যাটফর্মে কেটার করবে? হিণ্ডু ভাত, ডাল, মাছ, দহি?
হাজারি নরেনের মুখের দিকে চাহিল। সাহেবের কথা সে বুঝিতে পারিল না। নরেন ব্যাপারটা সাহেবের নিকট ভাল করিয়া বুঝিয়া লইয়া হাজারিকে বুঝাইল। রেলযাত্রীর সুবিধার জন্য রেল কোম্পানী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা হিন্দু ভাতের হোটেল খুলিতে চায়। সাহেব হাজারির নামডাক শুনিয়া তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছে। আপাততঃ দেড়শো টাকা জমা দিলে উহারা লাইসেন্স মঞ্জুর করিবে এবং রেলের খরচে হোটেলের ঘর বানাইয়া দিবে।
হাজারি সাহেবের কাছে বলিয়া আসিল সে রাজী আছে।
স্টেশন মাস্টার নরেনকে একখানা টেণ্ডার ফর্ম দিয়া ঘরগুলি পুরাইয়া হাজারির নাম সই করিয়া আনিতে বলিয়া দিলেন। স্টেশনের এই হোটেল লইয়া তারপর জোর কমপিটিশন চলিল। নৈহাটির এবং কৃষ্ণনগরের দুইজন ভাটিয়া হোটেলওয়ালা টেণ্ডার দিল এবং ওপর ওয়ালা কর্মচারীদের নিকট তদ্বিরতাগাদাও শুরু করিল।
নিজ রাণাঘাটের বাজারে এ খবরটা কেহ রাখিত না–শেষের দিকে, অর্থাৎ যখন টেণ্ডারের তারিখ শেষ হইবার অল্প কয়েকদিন মাত্র বাকী, যদু বাঁড়ুয্যে কথাটা শুনিল। স্টেশনের একজন ক্লার্ক যদুর হোটেলে খায়, সেই কি করিয়া জানিতে পারিয়া যদুকে বলিল–একটু চেষ্টা করুন না। আপনি–টেণ্ডার দিন। হয়ে যেতে পারে।
যত্ন চুপি চুপি টেণ্ডার সই করিয়া পাঁচ টাকা টেণ্ডারের জন্য জমা দিয়া আসিল।
সেদিন বেচু চক্কত্তি সবে হোটেলের গদিতে আসিয়া বসিয়াছে এমন সময় পদ্মঝি ব্যস্তসমস্ত হইয়া আসিয়া বলিল–শুনেছ গো? শুনে এলাম একটা কথা–
–কি?
–ইস্টিশানে ভাতের হোটেল খুলে দেবে রেল কোম্পানি, দরখাস্ত দাও না কর্তা।
–ইস্টিশানে? ছোঃ, ওতে খদ্দের হবে না। দূরের যাত্রীদের মধ্যে কে ভাত খাবে? সব কলকাতা থেকে খেয়ে আসবে–
–তোমার এই সব বসে বসে পরামর্শ আর রাজা-উজীর মারা; সবাই দূরের যাত্রী থাকে না –যারা গাড়ী বদলে খুলনে লাইনে যাবে, তারা খাবে, দুপুরে যে সব গাড়ী কলকাতায় যায়–তারা এখানে ভাত পেলে এখানেই খেয়ে যাবে। শুনলাম বাঁড়ুধ্যে মশায় নাকি দরখাস্ত দিয়েছে পাঁচ টাকা জমা দিয়ে–
বেচু চক্কত্তির চমক ভাঙিল। যদু বাঁড়ুয্যে যদি দরখাস্ত দিয়া থাকে, তবে এ দুধে সর আছে, কারণ যদু বাঁড়ুয্যে ঘুঘু হোটেলওয়ালা। পয়সা আছে না বুঝিয়া সে টেণ্ডারের পাঁচ টাকা জমা দিত না। বেচু বলিল–যাই, একবার দরখাস্ত দিয়ে আসি তবে–
পদ্মঝি বলিল–কেরানী বাবুদের কিছু খাইয়ে এস–নইলে কাজ হবে না। আমাদের হোটেলে সেই যে শশধরবাবু খেতো, তার শালা ইষ্টিশানের মালবাবু, তার কাছে সুলুকসন্ধান নিও। না করলে চলবে কি করে? এ হোটেলের অবস্থা দেখে দিন দিন হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদিয়ে যাচ্ছে।
–কেন ওবেলা খদ্দের তো মন্দ ছিল না?
পদ্মঝি হতাশার সুরে বলিল–ওকে ভাল বলে না কর্তা। সতেরো জন থাড কেলাসে আর ন’জন বাধা খদ্দেরে টাকা দিচ্ছে তবে হোটেল চলছে–নইলে বাজার হোত না। মুদি ধার দেওয়া বন্ধ করবে বলে শাসিয়েছে, তারই বা দোষ কি–একশো টাকার ওপর বাকী।