লোকটা তখন তর্কের মোড় ঘুরাইয়া ফেলিল। সে যেন ঝগড়া করিবার জন্যই তৈরী হইয়া আসিয়াছে। পাত হইতে হাত তুলিয়া চোখ গরম করিয়া চীৎকার করিয়া বলিল তবে তুমি কি বলতে চাও আমি মিথ্যে কথা বলছি?
হাজারি নরম হইয়া বলিল–না বাবু তা তো আমি বলচি না। কিন্তু আপনার ভুলও তো হতে পারে। আমি দিব্যি করে বলচি বাবু, বাসি ভাত আমার হোটেলে থাকে না–
–থাকে না? বড্ড নবাবী কথা বলছ যে। বাসি ভাত আবার এ বেলা হাঁড়িতে ফেলে দাও না তুমি?
–না বাবু।
–পষ্ট দেখতে পাচ্ছি– আবার তবুও না বলছ? দেখবে মজা?
এই সময়ে নরেন ও হোটেলের আরও দু একজন সেখানে আসিয়া পড়িল। নরেন গরম হইয়া বলিল–কি মজা দেখাবেন আপনি?
–দেখবে? সরে এসো দেখাচ্ছি–জোচ্চোর সব কোথাকার–
এই কথায় একটা মহা গোলমাল বাধিয়া গেল। পুরানো খরিদ্দাররা সকলেই হাজারির পক্ষ অবলম্বন করিল। লোকটা রাস্তায় দাঁড়াইয়া চীৎকার করিতে লাগিল–রাস্তার সমবেত জনতার সামনে দাঁড়াইয়া বলিতে লাগিল–শুনুন মশাই সব বলি। এই এর হোটেলে বাসি ভাত দিয়েছিল খেতে–ধরে ফেলেছি কিনা তাই এখন আবার আমাকে মারতে আসছে–পুলিশ ডাকবো এখুনি–স্যানিটারি দারোগাকে দিয়ে রিপোর্ট করিয়ে তবে ছাড়বো–জোচ্চোর কোথাকার–লোক মারবার মতলব তোমাদের?
এই সময় হোটেলের চাকর শশী হাজারিকে ডাকিয়া বলিল–বাবু, এই লোকটাকে যেন আমি বেচু চক্কত্তির হোটেলে দেখেছি। সেখানে যে ঝি থাকে, তার সঙ্গে বাজার করে নিয়ে যেতে দেখেছি–
নরেনের সাহস খুব। সে হোটেলের রোয়াকে দাঁড়াইয়া চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল–মশাই, আপনি বেচু চক্কত্তির হোটেলের পদ্মঝিয়ের কে হন?
তবুও লোকটা ছাড়ে না। সে হাত-পা নাড়িয়া প্রমাণ করিতে গেল পদ্মঝিয়ের নামও সে কোনোদিন শোনে নাই। কিন্তু তাহার প্রতিবাদের তেজ যেন তখন কমিয়া গিয়াছে।
কে একজন বলিয়া উঠিল–এইবার মানে মানে সরে পড় বাবা, কেন মার খেয়ে মরবে।
কিছুক্ষণ পরে লোকটাকে আর দেখা গেল না।
এই ঘটনার পরে অনেক রাত্রে হাজারি বেচু চক্কত্তির হোটেলে গিয়া হাজির হইল। বেচু চক্কত্তি তহবিল মিলাইতেছিল, হাজারিকে দেখিয়া একটু আশ্চর্য্য হইয়া বলিল–কি, হাজারি যে? এসো এসো। এত রাত্রে কি মনে করে?
হাজারি বিনীতভাবে বলিল–বাবু, একটা কথা বলতে এলাম।
–কি–বল?
–বাবু আপনি আমার অন্নদাতা ছিলেন একসময়ে–আজও আপনাকে তাই বলেই ভাবি। আপনার এখানে কাজ না শিখলে আজ আমি পেটের ভাত করে খেতে পারতাম না। আপনার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা আছে বলে আমি তো ভাবিনে।
–কেন, কেন, একথা কেন?
হাজারি সব ব্যাপার খুলিয়া বলিল। পরে হাত জোড় করিয়া বলিল–বাবু, আপনি ব্রাহ্মণ, আমার মনিব। আমাকে এভাবে বিপদে না ফেলে যদি বলেন হাজারি তুমি হোটেল উঠিয়ে দাও, তাই আমি দেবো। আপনি হুকুম করুন–
বেচু চক্কত্তি আশ্চর্য হইবার ভান করিয়া বলিল–আমি তো এর কোনো খবর রাখিনে– আচ্ছা, তুমি যাও আজ, আমি তদন্ত করে দেখে তোমায় কাল জানাবো। আমাদের কোন লোক তোমার হোটেলে যায় নি এ একেবারে নিশ্চয়। কাল জানতে পারবে তুমি।… তারপর হাজারি চলচে-টলচে ভাল?
–একরকম আপনার আশীর্বাদে–
–রোজ কি রকম বিক্রীসিক্রি হচ্ছে? রোজ তবিলে কি রকম থাকে। তুমি কিছু মনে কোরো না–তোমাকে আপনার লোক বলে ভাবি বলেই জিজ্ঞেস করচি।
–এই বাবু পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা–ধরুন না কেন আজ রাত্তিরের বিল দেখে এসেছি ছত্রিশ টাকা স’বারো আনা।
বেচু চক্কত্তি আশ্চর্য্য হইলেন মনে মনে। মুখে বলিলেন–বেশ, বেশ। খুব ভালো–শুনে খুশি হলাম। আচ্ছা, তাহলে এসো আজগে। কাল খবর পাবে।
হাজারি চলিয়া গেলে বেচু চক্কত্তি পদ্মঝিকে ডাকাইলেন। পদ্ম আসিয়া বলিল–হাজারি ঠাকুরটা এসেছিল নাকি? কি বলচিল?
বেচু চক্কত্তি বলিলেন –ও পদ্ম, হাজারি যে অবাক করে দিয়ে গেল। রাণাঘাটের বাজারে হোটেল করে পঁয়ত্রিশ টাকা থেকে চল্লিশ টাকা রোজকার দাঁড়া-তবিল, এ তো কখনো শুনি নি। তার মানে বুঝচো? দাঁড়া-তবিলে গড়ে ত্রিশ টাকা থাকলেও সাত-আট টাকা দৈনিক লাভ, ফেলে-ঝেলেও। মাসে হোল আড়াইশো টাকা। দুশো টাকার তো মার নেই–হ্যাঁ পদ্ম?
পদ্মঝি মুখভঙ্গি করিয়া বলিল–গুল দিয়ে গেল না তো?
–না, গুল দেবার লোক নয় ও। সাদাসিধে মানুষটা–আমায় বড্ড মানে এখনও। ও গুল দেবে না, অন্তত আমার কাছে। তা ছাড়া দেখছ না রেলবাজারে কোন হোটেলে আর বিক্রী নেই। সব শুষে নিচ্ছে ওই একলা।
–আজ নৃসিংহ গিয়েছিল বাবু ওর হোটেলে। খুব খানিকটা রাউ করে দিয়েও এসেছে নাকি। খুব চেঁচিয়েছে বাসি ভাত পচা মাছ এই বলে। আর কিছু হোক না হোক লোকে শুনে তো রাখলে?
–যদু বাঁড়ুয্যেরাও আমায় ডেকে পাঠিয়েছিল, ওর হোটেল ভাঙতেই হবে। নইলে রেলবাজারে কেউ আর টিকবে না। এই কথা যদু বাঁড়ুয্যেও বললে। কিন্তু তাতে কি হবে না–ওর এখন সময় যাচ্ছে ভালো। নৃসিংহ আছে?
–না বেরিয়ে গেল। পুলিশে সেই যে খবর দেবার কি হোল?
–দেখ পদ্ম, আমি বলি ওরকম আর পাঠিয়ে দরকার নেই। হাজারি লোকটা ভালো–আজ এসেছিল, এমন হাত জোড় করে নরম হয়ে থাকে যে দেখলে ওর ওপর রাগ থাকে না।
–খ্যাংরা মারি ওর ভালমানষেতার মুখে–ভিজে বেড়ালটি, মাছ খেতে কিন্তু ঠিক আছে –পুলিশের সেই যে মতলব দিয়েছিল যদুবাবু, তাই তুমি করো এবার। ওর হোটেল না ভাঙলে চলবে না। নয়তো আমাদের পাততাড়ি গুটুতে হবে এই আমি বলে দিলাম–এবেলা তবিল কত?