বেশ ছেলেটি।
নতুন জামাই? কে নতুন জামাই? কাহাদের নতুন জামাই?
মা এক-একটা কথা বলে কি যে, তার মানে হয় না।
.
টেঁপির মা কখনও এত বড় শহর দেখে নাই।
এখানকার কাণ্ডকারখানা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গিয়াছে। মোটর গাড়ী, ঘোড়ার গাড়ী, ইস্টিশানে বিদ্যুতের আলো, লোকজনই বা কত! আর তাদের এঁড়োশোলায় দিনমানেই শেয়াল তাকে বাড়ীর পিছনকার ঘন বাঁশবনে। সেদিন তো দিনদুপুরে জেলেপাড়ার কেষ্ট জেলের তিন মাসের ছেলেকে শেয়ালে লইয়া গেল।
ইতিমধ্যে কুসুম আসিয়া একদিন উহাদের বেড়াইতে লইয়া গেল। কুসুমের সঙ্গে তাহার রাধাবল্পভতলা, সিদ্ধেশ্বরীতলা, চূর্ণীর ঘাট, পালচৌধুরীদের বাড়ী–সব ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিল। পালচৌধুরীদের প্রকাণ্ড বাড়ী দেখিয়া টেঁপির মা ও টেঁপি দু-জনেই অবাক। এত বড় বাড়ী জীবনে তাহারা দেখে নাই। অতসীদের বাড়ীটাই এতদিন বড়লোকের বাড়ীর চরম নিদর্শন বলিয়া ভাবিয়া আসিয়াছে যাহারা, তাহাদের পক্ষে অবাক হইবার কথা বটে।
টেঁপির মা বলিল–না, শহর জায়গা বটে কুসুম! গায়ে গায়ে বাড়ী আর সব কোঠাবাড়ী এদেশে। সবাই বড়লোক। ছেলেমেয়েদের কি চেহারা, দেখে চোখ জুড়ায়। হাঁরে, এদের বাড়ী ঠাকুর হয় না? পুজোর সময় একদিন আমাদের এনো মা, ঠাকুর দেখে যাবো।
সে আর ইহার বেশী কিছুই বোঝে না।
একটা বাড়ীর সামনে কত কি বড় বড় ছবি টাঙানো, লোকজন ঢুকিতেছে, রাস্তার ধারে কি কাগজ বিলি করিতেছে। টেঁপির মনে হইল এই বোধ হয় সেই টকি যাকে বলে, তাহাই। কুসুমকে বলিল–কুসুম দি, এই টকি না?
–হ্যাঁ দিদি। একদিন দেখবে?
-–এক দিন এনো না আমাদের। মা-ও কখনো দেখে নি–সবাই আসবো।
একখানা ধাবমান মোটর গাড়ীর দিকে টেঁপির মা হাঁ করিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল, যতক্ষণ সেখানা রাস্তার মোড় ঘুরিয়া অদৃশ্য না হইয়া গেল।
কুসুম বলিল–আমার বাড়ী একটু পায়ের ধূলো দিন এবার জ্যাঠাইমা
কুসুমের বাড়ী যাইতে পথের ধারে রেলের লাইন পড়ে। টেঁপির মা বলিল–কুসুম, দাঁড়া মা একখানা রেলের গাড়ী দেখে যাই–
বলিতে বলিতে একখানা প্রকাণ্ড-মালগাড়ী আসিয়া হাজির। টেঁপি ও টেঁপির মা দুজনেই একদৃষ্টে দেখিতে লাগিল। গাড়ী চলিয়াছে তো চলিয়াছে–তাহার আর শেষ নাই।
উঃ, কি বড় গাড়ীটা!
কুসুম বলিল–জ্যাঠাইমা, রাণাঘাট ভাল লাগছে?
-লাগচে বৈকি, বেশ জায়গা মা।
আসলে কিন্তু এঁড়োশোলার জন্য টেঁপির মায়ের মন কেমন করে। শহরে নিজেকে সে এখনও খাপ খাওয়াইতে পারে নাই। সেখানকার তালপুকুরের ঘাট, সদা বোষ্টমের বাড়ীর পাশ দিয়া যে ছোট নিভৃত পথটি বাঁশবনের মধ্য দিয়া বাঁড়ুয্যে-পাড়ার দিকে গিয়াছে, দুপুর বেলা তাহাদের বাড়ীর কাছে বড় শিরীষ গাছটায় এই সময় শিরীষের সুঁটি শুকাইয়া ঝুন ঝুন শব্দ করে, তাহাদের উঠানের বড় লাউমাচায় এতদিন কত লাউ ফলিয়াছে, পেঁপে গাছটায় কত পেঁপের ফুল ও জালি দেখিয়া আসিয়াছিল–সে সবের জন্য মন কেমন করে বৈকি।
তবে এখানে যাহা সে পাইয়াছে টেঁপির মা জীবনে সে রকম সুখের মুখ দেখে নাই। চাকরের ওপর হুকুম চালাইয়া কাজ করাইয়া লওয়া, সকলে মানে, খাতির করে–অমন সুন্দর ছেলেটি তাহাদের হোটেলের মূহুরী– এ ধরনের ব্যাপারে কল্পনাও কখনও সে করিয়াছিল?
কুমের বাড়ী সকলে গিয়া পৌঁছিল। কুসুম ভারি খুশি হইয়া উঠিয়াছে–তাহার বাপের বাড়ী দেশের ব্রাহ্মণ-পরিবারকে এখানে পাইয়া। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া টেঁপির মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল–আমাদের বড্ড ভাগ্যি মা, আপনাদের চরণ-ধূলো পড়লো এ বাড়ীতে।
টেঁপির মাকে এত খাতির কবিয়া কেহ কখনো কথা বলে নাই–এত সুখও তাহার কপালে লেখা ছিল! হায় মা ঝিটকিপোতার বনবিবি, কি জাগ্রত দেবতাই তুমি! সেবার ঝিটকিপোতায় চৈত্র মাসে মেলায় গিয়া টেঁপির মা বনবিবিতলায় স-পাঁচ আনার সিন্নি দিয়া স্বামীপুত্রের মঙ্গলকামনা করিয়াছিল, এখনও যে বছর পার হয় নাই! তবুও লোকে ঠাকুর দেবতা মানিতে চায় না।
কুসুম সকলকে জলযোগ করাইল। পান সাজিয়া দিল। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া কতক্ষণ গল্পগুজব করিল। কুসুম গ্রামের কথাই কেবল শুনিতে চায়। কতদিন বাপের বাড়ী যায় নাই, বাবা-মা মরিয়া গিয়াছে, জ্যাঠামশায় আছে, কাকারা আছে–তাহারা কোনো দিন খোঁজও নেয় না। খোঁজ করিত অবশ্যই, যদি তাহার নিজের অবস্থা ভাল হইত। গরীব লোকের আদর কে করে?…এই সব অনেক দুঃখ কৰিল। আরও কিছুক্ষণ বসিবার পরে কুসুম উহাদের বাসায় পৌঁছিয়া দিয়া গেল।
০৮. রাত্রে এক মজার ব্যাপার ঘটিল
হাজারির হোটেলে রাত্রে এক মজার ব্যাপার ঘটিল সেদিন।
দশ-পনেরোটি লোক একই সঙ্গে খাইতে বসিয়াছে–হঠাৎ একজন বলিয়া উঠিল–ঠাকুর, এই যে ভাতটা দিলে, এ দেখছি ও বেলার বাসি ভাত।
বংশী ঠাকুর ভাত দিতেছিল, সে অবাক হইয়া বলিল—আজ্ঞে বাবু সে কি? আমাদের হোটেলে ওরকম পাবেন না। আধ মণ চাল এক-একবেলা রান্না হয়, তাতেই কুলোয় না– বাসি ভাত থাকবে কোথা থেকে?
–আলবাৎ এ ও-বেলার ভাত। আমি বলচি এ ও-বেলার ভাত–
গোলমাল শুনিয়া হাজারি আসিয়া বলিল–কি হয়েছে বাবু?…বাসি ভাত? কক্ষনো না। আপনি নতুন লোক, কিন্তু এঁরা যাঁরা খাচ্ছেন তাঁরা আমায় জানেন–আমার হোটেল না চলে না চুলক কিন্তু ওসব পিরবিত্তি ভগবান যেন আমায় না দেন—