হঠাৎ টেঁপির কেমন একটা অহেতুক স্নেহ আসিল ছেলেটির প্রতি।
আহা, হোটেলে কত রাত পর্যন্ত জাগে। ভাল ঘুম হয় না রাত্রে!
টেঁপি আসিয়া মাকে বলিল–মা সেই লোকটা এখনও ঘুমুচ্ছে। ডেকে দেবো, না ঘুমুবে।
টেঁপির মা বলিল–ঘুমুচ্ছে ঘুমুক না। ডাকবার দরকার কি? চাকরটা কোথায় গেল? ঘুম থেকে উঠলে ওকে কিছু খেতে দিতে হবে। খাবার আনতে দিতাম। উনিও তো বাড়ী নেই।
টেঁপি বলিল–লোকটা চা খায় কিনা জানিনে, তাহলে ঘুম থেকে উঠলে একটু চা করে দিতে পারলে ভাল হোত।
টেঁপির মা চা নিজে কখনো খায় নাই, করিতেও জানে না। আধুনিকা মেয়ের এ প্রস্তাব তাহার মন্দ লাগিল না।
মেয়েকে বলিল–তুই করে দিতে পারবি তো?
মেয়ে খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল–তুমি যে কি বল মা, হেসে প্রাণ বেরিয়ে যায়– পরে কেমন একটি অপূৰ্ব ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়া নাড়িয়া হাসিভরা মুখের চিবুকখানি বার বার উঠাইয়া-নামাইয়া বলিতে লাগিল–চা কই? চিনি কই? কেটলি কই? চায়ের জল ফুটবে কিসে? ডিস-পেয়ালা কই? সে সব আছে কিছু?
টেঁপির মায়ের বড় ভাল লাগিল টেঁপির এই ভঙ্গি। সে সস্নেহে মুগ্ধদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। এমন ভাবে এমন সুন্দর ভঙ্গিতে কথা টেঁপি আর কখনও বলে নাই।
এই সময় হাজারি বাড়ীর মধ্যে ঢুকিল, হোটেলেই ছিল। বলিল–নরেন কোথায়? ঘুমুচ্ছে নাকি?
টেঁপির মা বলিল–তুমি এতক্ষণ ছিলে কোথায়? ওকে একটু খাবার আনিয়ে দিতে হবে। আর টেঁপি বলছে চা করে দিলে হোত।
হাজারির বড় স্নেহ হইল টেঁপির উপর। সে না জানিয়া যাহাকে আজ যত্ন করিয়া চা খাওয়াইতে চাহিতেছে, তাহারই সঙ্গে তার বাবা-মা যে বিবাহের ষড়যন্ত্র করিতেছে–বেচারী কি জানে?
বলিল–আমি সব এনে দিচ্ছি। হোটেলেই আছে। হোটেলে বড় ব্যস্ত আছি, কলকাতা থেকে দশ-বারো জন বাবু এসেছে শিকার করতে। ওর। অনেকদিন আগে একবার এসে আমার রান্না মাংস খেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। সেই আগের হোটেলে গিয়েছিল, সেখানে নেই শুনে খুঁজে খুঁজে এখানে এসেছে। ওরা রাত্রে মাংস আর পোলাও খাবে। তোমরা এবেলা রান্না কোরো না–আমি হোটেল থেকে আলাদা করে পাঠিয়ে দেবো এখন। নরেনকে যে একবার দরকার, বাবুদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথাবার্তা কইতে হবে, সে তো আমি পারবো না, নরেনকে ওঠাই দাঁড়াও–
টেঁপির মা বলিল–ঘুম থেকে উঠিয়ে কিছু না খাইয়ে ছাড়া ভাল দেখায় না। টেঁপি চায়ের কথা বলচিল–তা হোলে সেগুলো আগে পাঠিয়ে দেওগে, এখন জাগিও না।
.
বৈকালের দিকে নরেন ঘুম ভাঙিয়া উঠিল। অত্যন্ত বেলা গিয়াছে, পাঁচিলের ধারে সজনে গাছটার গায়ে রোদ হলদে হইয়া আসিয়াছে। নরেনের লজ্জা হইল– পরের বাড়ী কি ঘুমটাই ঘুমাইয়াছে। কে কি–বিশেষ করিয়া হাজারি-মামার মেয়েটি কি মনে করিল। বেশ মেয়েটি। হাজারি-মামার মেয়ে যে এমন চালাক-চতুর, চটপটে, এমন দেখিতে, এমন কাপড়-চোপড় পরিতে জানে তাহা কে ভাবিয়া ছিল?
অপ্রতিভ মুখে সে গায়ে জামা পরিয়া বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় টেঁপি আসিয়া বলিল–আপনি উঠেছেন? মুখ ধোবার জল দেবো?
নরেন থতমত খাইয়া বলিল–না, না, থাক আমি হোটেলেই–
–মা বললে আপনি চা খেয়ে যাবেন, আমি মাকে বলে আসি—
ইতিমধ্যে হাজারি চায়ের আসবাব হোটেলের চাকর দিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল, টেঁপি নিজেই চা করিতে বসিয়া গেল। তাহার মা জলখাবারের জন্য ফল কাটিতে লাগিল।
টেঁপি বলিল–মা চায়ের সঙ্গে শসা-টসা দেয় না। তুমি বরং ঐ নিমকি আর রসগোল্লা দাও রেকাবিতে–
–শসা দেয় না? একটা ডাব কাটবো? বাড়ীর ভাব আছে—
টেঁপি হাসিতে হাসিতে গড়াইয়া পড়ে আর কি। মুখে আঁচল চাপা দিয়া বলিল–হি হি, তুমি মা যে কি!…চায়ের সঙ্গে বুঝি ডাব খায়?
টেঁপির মা অপ্রসন্ন মুখে বলিল–কি জানি তোদের একেলে ঢং কিছু বুঝিনে বাপু। যা বোঝো তাই করো। ঘুম থেকে উঠলে তো নতুন জামাইদের ডাব দিতে দেখেছি চিরকাল দেশেঘরে-
কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই টেঁপির মা মনে মনে জিভ কাটিয়া চুপ করিয়া গেল। মানুষটা একটু বোকা ধরনের, কি ভাবিয়া কি বলে, সব সময় তলাইয়া দেখিতে জানে না।
টেঁপি আশ্চর্য্য হইয়া বলিল–নতুন জামাই? কে নতুন জামাই?
–ও কিছু না; দেশে দেখেছি তাই বলচি। তুই নে, চা করা হোল?
টেঁপির মনে কেমন যেন খটকা লাগিল। সে খুব বুদ্ধিমতী, তাহার উপর নিতান্ত ছেলে মানুষটিও নয়, যখন চা ও খাবার লইয়া পুনরায় ছেলেটির সামনে গেল তখন তাহার কি জানি কেন যে লজ্জা করিতেছে তাহা সে নিজেই ভাল ধরিতে পারিল না।
ছেলেটি তাহাকে দেখিয়া বলিল–ও কি! এই এত খাবার কেন এখন, চা একটু হোলেই–
টেঁপি কোনো রকমে খাবারের রেকাবি লোকটার সামনে রাখিয়া পলাইয়া আসিলে যেন বাঁচে।
ছেলেটি ডাকিয়া বলিল–পান একটা যদি দিয়ে যান—
পান সাজিতে বসিয়া টেঁপি ভাবিল–বাবা খাটিয়ে মারলে আমায়! চা দেও–পান সাজো–আমার যেন যত গরজ পড়েছে, বাবার হোটেলের লোক তা আমার কি?
টেঁপি একটা চায়ের পিরিচে পান রাখিয়া দিতে গেল। ছেলেটি দেখিতে বেশ কিন্তু। কথাবার্তা বেশ, হাসি-হাসি মুখ। কি কাজ করে হোটেলে কে জানে?
পান লইয়া ছেলেটি চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিয়া গেল–মামীমা আমি যাচ্ছি, কষ্ট দিয়ে গেলাম অনেক, কিছু মনে করবেন না। এত ঘুমিয়েছি, বেলা আর নেই আজ।