বহুদিনের বাসনা ঠাকুর রাধাবল্লভ পূর্ণ করিয়াছেন। হাজারি এখন হোটেলের মালিক। বেচু চক্কত্তির সমান দরের লোক সে আজ। অত্যন্ত ইচ্ছা হইল, যত জানাশোনা পরিচিত লোক যে যেখানে আছে–সকলকেই কথাটা বলিয়া বেড়ায়। মনের আনন্দ চাপিতে না পারিয়া বৈকালে কুসুমের বাড়ী গিয়া হাজির হইল। কুসুম বলিল–কেমন চললো হোটেল জ্যাঠামশায়?
–বেশ খদ্দের পাচ্চি। আমার বড্ড ইচ্ছে তুমি একবার এসে দেখে যাও–তুমি তো অংশীদার–
–যাবো এখন। কাল সকালে যাবে। আপনার মনিব কি বল্লে?
–রেগে কাই। ও মাসের মাইনে দেয় নি–না দিকগে, সত্যিই বলচি কুসুম মা, আমার বয়েস কে বলে আটচল্লিশ হয়েচে? আমার যেন মনে হচ্চে আমার বয়েস পনের বছর কমে গিয়েচে। হাতপায়ে বল এসেচে কত! তুমি আর আমার অতসী মা–তোমরা আর জন্মে আমার কি ছিলে জানিনে—তোমাদের–
কুসুম বাধা দিয়া বলিল–আবার ওই সব কথা বলছেন জ্যাঠামশায়? আমার টাকা দিইচি সুদ পাবো বলে। এ তো ব্যবসায় টাকা ফেলা–টাকা কি তোরঙ্গের মধ্যে থেকে আমার স্বগগে পিদিম দিতো? বলি নি আমি আপনাকে? তবে হ্যাঁ, আমাদের বাবুর মেয়ের কথা যা বল্লেন, সে দিয়েছে বটে কোন খাঁই না করে। তার কথা, হাজার বার বলতে পারেন। তার বিয়ের কি হোল?
–সামনের সোমবার বিয়ে। চিঠি পেয়েছি–যাচ্ছি ওদিন সকালে।
–আমার কাকার সঙ্গে যদি দেখা হয় তবে এসব টাকাকড়ির কথা যেন বলবেন না সেখানে।
–তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে না মা, যতবার দেখা হয়েচে তোমার নামটি পর্যন্ত কখনো সেখানে ঘূণাক্ষরে করি নি। আমারও বাড়ী এঁড়োশোলা, আমায় তোমার কিছু শেখাতে হবে না।
কথামত পরদিন সকালে কুসুম হোটেল দেখতে গেল। সে দুধ দই লইয়া অনেক বেলা পৰ্য্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় বেড়ায়– তাহার পক্ষে ইহা আশ্চর্যের কথা কিছুই নহে।
হাজারি তাহাকে রান্নাঘরে যত্ন করিয়া বসাইতে গেল–সে কিন্তু দোরের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল, বলিল–আমি গুরুঠাকরুন কিছু আসি নি যে আসন পেতে যত্ন করে বসাতে হবে।
হাজারি বলিল–তোমারও তো হোটেল কুসুম-মা–তুমি এর অংশীদারও বটে, মহাজনও বটে। নিজের জিনিস ভাল করে দেখে শোনো। কি হচ্ছে না হচ্চে তদারক করো–এতে লজ্জা কি? বংশী, চিনে রাখো এ একজন অংশীদার।
এ কথায় কুসুম খুব খুশি হইল–মুখে তাহার আহ্লাদের চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল। এমন একটা হোটেলের সে অংশীদার ও মহাজন–এ একটা নতুন জিনিস তাহার জীবনে। এ ভাবে ব্যাপারটা বোধ হয় ভাবিয়া দেখে নাই। হাজারি বলিল–আজ মাছ রান্না হয়েছে বেশ পাকা রুই। তুমি একটু বোসো মা, মুড়োটা নিয়ে যাও।
–না না জ্যাঠামশায়।–ওসব আপনাকে বারণ করে দিইচি না! সকলের মুখ বঞ্চিত করে আমি মাছের মুড়ো খাবো–বেশ মজার কথা!
–আমি তোমার বুড়ো বাবা, তোমাকে খাইয়ে আমার যদি তৃপ্তি হয়, কেন খাবে না বুঝিয়ে দাও।
হোটেলের চাকর হাঁকিল–থাড কেলাস তিন থালা–-
হাজারি বলল–খদ্দের আসছে বোসো মা একটু। আমি আসছি, বংশী ভাত বেড়ে ফেলো।
আসিবার সময় কুসুম সলজ্জ সঙ্কোচের সহিত হাজারির দেওয়া এক কাঁসি মাছ তরকারি লইয়া আসিল।
.
এক বছর কাটিয়া গিয়াছে।
হাজারি এঁডোশোলা হইতে গরুর গাড়ীতে রাণাঘাট ফিরিতেছে, সঙ্গে টেঁপির মা, টেঁপি ও ছেলেমেয়ে। তাহার হোটেলের কাজ আজকাল খুব বাড়িয়া গিয়াছে। রাণাঘাটে বাসা না করিলে আর চলে না।
টেঁপির মা বলিল–আর কতটা আছে হ্যাঁ গা?
–ওই তো সেগুন বাগান দেখা দিয়েছে–এইবার পৌঁছে যাবো
টেঁপি বলিল–বাবা, সেখানে নাইবো কোথায়? পুকুর আছে না গাঙ?
–গাঙ আছে, বাসায় টিউব কল আছে।
টেঁপির মা বলিল–তাহোলে জল টানতে হবে না পুকুর থেকে। বেঁচে যাই–
ইহারা কখনো শহরে আসে নাই–টেঁপির মার বাপের বাড়ী এঁডোশোলার দু ক্রোশ উত্তরে মণিরামপুর গ্রামে। জন্ম সেখানে, বিবাহ এঁড়োশোলায়, শহর দেখিবার একবার সুযোগ হইয়াছিল অনেকদিন আগে, অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামের য়েদের সঙ্গে একবার নবদ্বীপে রাস দেখিতে গিয়াছিল।
হোটেলের কাছেই একখানা একতলা বাড়ী পূৰ্ব্ব হইতে ঠিক করা ছিল। টেঁপির মা বাড়ী দেখিয়া খুব খুশি হইল। চিরকাল খড়ের ঘরে বাস করিয়া অভ্যাস, কোঠাঘরে বাস এই তাহার প্রথম।
–কখানা ঘর গা? রান্নাঘর কোন্ দিকে? কই তোমার সেই টিউকল দেখি? জল বেশ ও তো? ওরে টেঁপি, গাড়ীর কাপড়গুলো আলাদা করে রেখে দে–একপাশে। ও-সব নিয়ে ছিষ্টি ছোঁয়ানেপা করো না যেন, বস্তার মধ্যে থেকে একটা ঘটি আগে বের করে দাও না গো, এক ঘটি জল আগে তুলে নিয়ে আসি।
একটু পরে কুসুম আসিয়া ঢুকিয়া বলিল–ও জেঠিমা, এলেন সব? বাসা পছন্দ হয়েছে তো?
টেঁপির মা কুসুমকে চেনে। গ্রামে তাহাকে কুমারী অবস্থা হইতেই দেখিয়াছে। বলিল– এসো মা কুসুম, এসো এসো! ভাল আছ তো? এসো এসো কল্যেণ হোক।
হোটেলের চাকর রাখাল এই সময় আসিল। তাহার পিছনে মুটের মাথায় এক বস্তা পাথুরে কয়লা। হাজারিকে বলিল–কয়লা কোনদিকে নামাবো বাবু?
হাজারি বলিল–কয়লা আনলি কেন রে? তোকে যে বলে দিলাম কাঠ আনতে? এর কয়লার আঁচ দিতে জানে না।
কুসুম বলিল–কয়লার উনুন আছে? আমি আঁচ দিয়ে দিচ্ছি। আর শিখে নিতে তো হবে জেঠিমাকে। কয়লা সস্তা পড়বে কাঠের চেয়ে এ শহর-বাজার জায়গায়। আমি একদিনে শিখিয়ে দেবো জেঠিমাকে।
রাখাল কয়লা নামাইয়া বলিল–বাবু, আর কি করতে হবে এখন?