তাহার খাওয়া অর্ধেক হয়েছে এমন সময় পদ্মঝি রান্নাঘরের দোরে আসিয়া হাজারিকে কি একটা বলতে গেল এবং গোগ্রাসে ভোজনরত যতীন মজুমদারকে দেখিয়া হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইল বলিল–ও কে?
হাজারি হাসিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, চিনতে পাচ্ছ না পদ্মদিদি? আমাদের পুরোনো বাবু। যাচ্ছিলেন রাস্তা দিয়ে, তা আমি বল্লাম আজ পুজোর দিনটা একটু পেরসাদ পেয়ে যান বাবু–
পদ্মঝি বলিল—বেশ–বলিয়াই সে ফিরিয়া আবার গিয়া মাসিক খরিদ্দারদের খাবার ঘরে ঢুকিল।
যতীন ততক্ষণ পদ্মঝিকে কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সে কথা বলিবার সুযোগ ঘটিল না তাহার। সে খাওয়া শেষ করিয়া এক ঘটি জল চাহিয়া লইয়া খাইয়া চোরের মত খিড়কি দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল।
অল্পক্ষণ পরেই গোবরা চাকর আসিয়া বলিল–ঠাকুর, কৰ্ত্তা তোমাকে ডাকছেন—
হাজারি বুঝিয়াছিল কর্তা কি জন্য তাহাকে জরুরী তলব দিয়াছেন। সে গিয়া বুঝিল তাহার অনুমান সত্য–কারণ পদ্মঝি মুখ ভার করিয়া গদির ঘরে বেচু চক্কত্তির সামনে দাঁড়াইয়া। বেচু চক্কত্তি বললেন–হাজারি, তুমি যতনেটাকে হোটেলে ঢুকিয়ে তাকে বসিয়ে সিন্নি খাওয়াচ্ছিলে?
পদ্মঝি হাত নাড়িয়া বলিল–আর খাওয়ানো বলে খাওয়ানো! এক এক গামলা সিন্নি দিয়েছে তার পাতে–ইচ্ছে ছিল নুকিয়ে খাওয়াবে, ধর্মের ঢাক বাতাসে নড়ে, আমি গিয়ে পড়েছি সেই সময় বড় ডেক নামলো কি না তাই দেখতে–আমায় দেখে–
হাজারি বিনীত ভাবে বলিল–সত্যনারাণের পেশাদ বলেই বাবু দিয়েছিলাম–আমাদের পুরোনো খদ্দের–
বেচু চক্কত্তি দাঁত খিঁচাইয়া বলিলেন–পুরোনো খদ্দের? ভারি আমার পুরোনো খদ্দের রে? হোটেলের একটি মুঠো টাকা ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে, ভারি খদ্দের আমার! চার মাস বিনি পয়সায় খেয়ে গেল একটি আধলা উপুড়-হাত করলে না, পয়লা নম্বরের জুয়াচার কোথাকার-খদ্দের! তুমি কার হুকুমে তাকে হোটেলে ঢুকতে দিলে শুনি?
পদ্মঝি বলিল–আমি কোনো কথা বল্লেই তো পদ্ম বড় মন্দ। এই হাজারি ঠাকুর কি কম শয়তান নাকি–বাবু? আপনি জানেন না সব কথা, সব কথা আপনার কানে তুলতেও আমার ইচ্ছে করে না। নুকিয়ে নুকিয়ে হোটেলের আদ্ধেক জিনিস ওঠে ওর এয়ার বকশীদের বাড়ী। যতনে ঠাকুর ওর এয়ার, বুঝলেন না আপনি? বহাল করেন লোক, তখন আমি কেউ নই– কিন্তু হাতে হাতে ধরে দেবার বেলা এই জনা না হোলেও দেখি চলে না–এই দেখুন আবার চুরি-চামারি শুরু যদি না হয় হোটেলে, তবে আমার নাম–
বেচু চক্কত্তি বলিলেন–এটা তোমার নিজের হোটেল নয় যে তুমি হাজারি ঠাকুর এখানে যা খুশি করবে। নিজের মত এখানে খাটালে চলবে না জেনো। তোমার আট আনা জরিমানা হোল।
হাজারি বলিল–বেশ বাবু, আপনার বিচারে যদি তাই হয়, করুন জরিমানা। তবে যতীন বাবু আমার এয়ারও নয় বা সে সব কিছুই নয়। এই হোটেলেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ–ওঁকে দেখিনিও কতদিন। পদ্মদিদি অনেক অনেয্য কথা লাগায় আপনার কাছে–আমি আসছে মাস থেকে আর এখানে চাকরি করবো না।
পদ্মঝি এ কথায় অনর্থ বাধাইল। হাত পা নাড়িয়া চীৎকার করিয়া বলিল–লাগায়? লাগায় তোমার নামে? তুমি যে বড় লাগাবার যুগ্যি লোক। তাই পদ্ম লাগিয়ে লাগিয়ে বেড়াচ্ছে তোমার নামে। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। তোমার মত লোককে পদ্ম গেরায্যির মধ্যে আনে না তা তুমি ভাল করে বুঝো ঠাকুর। যাও না, তুমি আজই চলে যাও। সামনের মাসে কেন, মাইনেপত্তর চুকিয়ে আজই বিদেয় হও না–তোমার মত ঠাকুর রেল-বাজারে গণ্ডায় গণ্ডায় মিলবে–
বেচু চক্কত্তি বলিলেন–চুপ চুপ পদ্ম, চুপ করো। খদ্দেরপত্র আসচে যাচ্চে, ওকথা এখন থাক। পরে হবে–আচ্ছা তুমি যাও এখন হাজারি ঠাকুর–
অনেক রাতে হোটেলের কাজ মিটিল।
শুইবার সময় হাজারি বংশীকে বলিল–দেখলে তো কি রকম অপমানটা আমার করলে পলদিদি? তুমিও ছাড়, চল দুজনে বেরিয়ে যাই। দ্যাখো একটা কথা বংশী, এই হোটেলের ওপর কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল, মুখে বলি বটে যাই যাই–কিন্তু যেতে মন সরে না। কতকাল ধরে তুমি আর আমি এখানে আছি ভেবে দ্যাখো তো? এ যেন আপনার ঘর বাড়ী হয়ে গিয়েছে–তাই না? কিন্তু এরা–বিশেষ করে পদ্মদিদি এখানে টিকতে দিলে না–এবার সত্যিই যাবো।
বংশী বলিল–ষতীনকে তুমি ডেকে দিলে না ও আপনি এসেছিল?
–আমি ডেকেছিলাম। ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েচে, আজকাল খেতেই পায় না। তাই ডাকলাম। বলি পুরোনো খদ্দের তো, কত লোক খেয়ে যাচ্চে, ও একটু সিন্নি খেয়ে যাক। এই তো আমার অপরাধ।
.
পরের মাসের শুভ পয়লা তারিখে রেলবাজারে গোপাল ঘোষের তামাকের দোকানের পাশেই নূতন হোটেলটা খুলিল! টিনের সাইনবোর্ড লেখা আছে—
আদর্শ হিন্দু-হোটেল
হাজারি ঠাকুর নিজের হাতে রান্না করিয়া থাকেন।
ভাত, ডাল, মাছ, মাংস সব রকম প্রস্তুত থাকে।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সস্তা।
আসুন! দেখুন!! পরীক্ষা করুন!!!
বেচু চক্কত্তির হোটেলের অনুকরণে সামনেই গদির ঘর। সেখানে বংশী ঠাকুরের ভাগ্নে সেই ছেলেটি কাঠের বাক্সের উপর খাতা ফেলিয়া খরিদ্দারগণের আনাগোনার হিসাব রাখিতেছে। ভিতরে রান্না করিতেছে বংশী ও হাজারি–বেচু চক্কত্তির হোটেলের মতই তিনটি শ্রেণী করা হইয়াছে, সেই রকম টিকিট কিনিয়া ঢুকিতে হয়।
তা নিতান্ত মন্দ নয়। খুলিবার দিন দুপুরের খরিদ্দার হইল ভালই! বংশী খাইবার ঘরে ভাত দিতে আসিয়া ফিরিয়া গিয়া হাজারিকে বলিল–থাড কেলাস ত্রিশ খানা। প্রথম দিনের পক্কে যথেষ্ট হয়েছে। ওবেলা মাংস লাগিয়ে দাও।