বংশী বলিল–সে তো বসেই আছে হাজারি-দা। একটা কাজ পেলে বেঁচে যায়। আমি আজই লিখছি আর ঘর আমি দেখে এসেছি–তামাকের দোকানের পাশে ঘরটা ভাল–ওইটেই নাও। লেগে যাও দুর্গা বলে।
০৭. একদিন সকালে পদ্মঝি বলিল
দিন দুই পরে একদিন সকালে পদ্মঝি বলিল–ও ঠাকুর, শুনে রাখো, আজ কোথাও যেও না সব ছুটির পরে। আজ ও-বেলা সত্যনারায়ণের সিন্নি–খদ্দেরদের ভাত দেবার সময় বলে দিও ও-বেলা যেন থাকে–আর তোমরা খেয়ে-দেয়ে আমার সঙ্গে বেরুবে সত্যনারায়ণের বাজার করতে।
বংশী ঠাকুর হাজারির দিকে চাহিয়া হাসিল–অবশ্য পদ্মঝি চলিয়া গেলে।
ব্যাপারটা এই, হোটেলের এই যে সত্যনারায়ণের পূজা, ইহা ইহাদের একটি ব্যবসা। যাহারা মাসিক হিসাবে হোটেলে খায় তাহাদের নিকট হইতে পূজার নাম করিয়া চাঁদা বা প্রণামী আদায় হয়। আদায়ী টাকার সব অংশ ব্যয় করা হয় না বলিয়াই হাজারি বা বংশীর ধারণা। অথচ, সত্যনারায়ণের প্রসাদের লোভ দেখাইয়া দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা তাহাদেরও রাত্রে আনিবার চেষ্টা করা হয়–কারণ এমন অনেক নগদ খরিদ্দার আছে, যাহারা একবেলা হোটেলে খাইয়া যায়, দু-বেলা আসে না।
বংশী ঠাকুর পরিবেশনের সময় প্রত্যেক ঠিকা খরিদ্দারকে মোলায়েম হাসি হাসিয়া বলিতে লাগি—আজ্ঞে বাবু, ও-বেলা সত্যনারাণ হবে হোটেলে, আসবেন ও-বেলা–অবিশ্যি করে আসবেন–
বাহিরে গদির ধরে বেচু চক্কত্তিও খরিদ্দারদিগকে ঠিক অমনি বলিতে লাগিল।
বংশী ঠাকুর হাজারিকে আড়ালে বলিল–সব ফাঁকির কাজ, এক চিলতে কলার পাতার আগায় এক হাত করে গুড় গোলা আটা আর তার ওপর দুখানা বাতাসা–হয়ে গেল এর নাম তোমার সত্যনারাণের সিন্নি। চামার কোথাকার–
সন্ধ্যার সময় পূর্ণ ভটচাজ সত্যনারায়ণের পূজা করিতে আসিলেন। বাসনের ঘরে সত্য নারায়ণের পিঁড়ি পাতা হইয়াছে। হোটেলের দুই চার মিলিয়া ঘড়ি ও কাঁসর পিটাইতেছে, পদ্মঝি ঘন ঘন শাঁকে ফুঁ পাড়িতেছে–খানিকটা খরিদ্দার আকৃষ্ট করিবার চেষ্টাতেও বটে।
স্টেশনে যে চাকর ‘হি-ই-ই-ন্দু হো-টে-ল-ল’ বলিয়া চেঁচায়, তাহাকেও বলিয়া দেওয়া হইয়াছে, সে যাত্রীদের প্রত্যেককে বলিতেছে–‘আসুন বাবু, সিমি পেশাদ হচ্চেন হোটেলে, খাওয়ার বড্ড জুৎ আজগে–আসুন বাবু–’
যাহারা নগদ পয়সার খরিদ্দার, তাহারা ভাবিতেছে–অন্য হোটেলেও তো পয়সা দিয়া খাইবে যখন তখন সত্যনারায়ণের প্রসাদ ফাউ যদি পাওয়া যায়, বেচু চকত্তির হোটেলেই যাওয়া যাক না কেন। ফলে যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলের দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা, তাহারাও অনেকে আসিয়া জুটিতেছে এই হোটেলে। এদিকে নগদ খরিদ্দারদের জন্য ব্যবস্থা এই যে, তাহাদের সিন্নি খাইতে দেওয়া হইবে ভাতের পাতে অর্থাৎ টিকিট কিনিয়া ভাত খাইতে ঢুকিলে তবে। নতুবা সিন্নিটুকু খাইয়া লইয়াই যদি খরিদ্দার পালায়?
মাসিক খরিদ্দারের জন্য অন্য প্রকার ব্যবস্থা। তাঁহারা চাঁদা দিয়াছে, বিশেষতঃ তাহাদের খাতির করাও দরকার। পূজা সাঙ্গ হইলে তাহাদের সকলকে একত্র বসাইয়া প্রাসাদ খাইতে দেওয়া হইল–বেচু চক্কত্তি নিজে প্রত্যেকের কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন তাহারা আর একটু করিয়া প্রসাদ লইবে কি না।
যখন ওদিকে মাসিক খরিদ্দাগণকে সিন্নি বিতরণ করা হইতেছে, সে সময় হাজারি দেখিল রাস্তার উপর যতীন মজুমদার দাঁড়াইয়া হাঁ করিয়া তাহাদের হোটেলের দিকে চাহিয়া আছে। সেই যতীন…
হাজারির মনে হইল লোকটার অবস্থা আরও খারাপ হইয়া গিয়াছে, কেমন যেন অনাহার-শীর্ণ চেহারা। সে ডাকিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, কেমন আছেন?
যতীন মজুমদার অবাক হইয়া বলিল–কে হাজারি নাকি? তুমি আবার কবে এলে এখানে।
–সে অনেক কথা বলবো এখন। আসুন না—আসুন—
যতীন ইতস্ততঃ করিয়া রান্নাঘরের পাশে বেড়ার গায়ের দরজা দিয়া হোটেলে ঢুকিয়া রান্নাঘরের দোরে আসিয়া দাঁড়াইল।
হাজারি দেখিল তাহার পায়ে জুতা নাই, গায়ে অতি মলিন উড়ানি, পরনের ধুতিখানিও তদ্রূপ। আগের চেয়ে রোগাও হইয়া গিয়াছে লোকটা। দারিদ্র্য ও অভাবের ছাপ চোখে মুখে বেশ পরিস্ফূট।
যতীন কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিল–আরে, তোমাদের এখানে বুঝি সত্যনারায়ণ হচ্চে আজগে? আগে আমিও কত এসেছি খেয়েছি–
–তা খাবেন না? আপনি তো ছিলেন বারোমাসের বাঁধা খদ্দের–তা আসুন পেরসাদ খেয়ে যান–
যতীন ভদ্ৰতা করিয়া বলিল–না না, থাক থাক–তার জন্যে আর কি হয়েচে–
হাজারি একবার এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিল কেহ কোনোদিকে নাই। সবাই খাবার ঘরে মাসিক খরিদ্দারের আদর আপ্যায়ন করিতে ব্যস্ত–সে কলার পাত পাতিয়া যতীনকে বসাইল এবং পাশে বাসনের ঘর হইতে বড় বাটির একবাটি সত্যনারায়ণের সিন্নি, একমুঠা বাতাসা ও দুটি পাকা কলা আনিয়া যতীনের পাতে দিয়া বলিল–একটু পেরসাদ খেয়ে নিন–
যতীন মজুমদার দ্বিরুক্তি না করিয়া সিন্নির সহিত কলাদুটি চটকাইয়া মাখিয়া লইয়া যেভাবে গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল, তাহাতে হাজারিরও মনে হইল লোকটা সত্যই যথেষ্ট ক্ষুধার্ত ছিল, বোধ হয় ওবেলা আহার জোটে নাই। তিন চার গ্রাসে অতখানি সিন্নি সে নিঃশেষে উড়াইয়া দিল।
হাজারি বলিল–আর একটু নেবেন?
যতীন পূর্বের মত ভদ্রতার সুরে বলিল–না না, থাক থাক আর কেন–
হাজারি আরও এক বাটি সিন্নি আনিয়া পাতে ঢালিয়া দিতে যতীনের মুখচোখ যেন উজ্জল হইয়া উঠিল।