বেশ মেয়ে অতসী, ভগবান ওর ভাল করুন। তাহার মন বলিতেছে ওর হাত দিয়া যে টাকা আসিয়াছে–সে টাকায় ব্যবসা খুলিলে লোকসান খাইবে না। স্বয়ং লক্ষ্মী যেন তাহার হাতে আসিয়া টাকা গুঁজিয়া দিয়া গেলেন।…
হোটেলে পৌঁছিয়া সে দেখিল রান্নাঘরে বংশী ঠাকুর ডাল চাপাইয়া একা বসিয়া। তাহাকে দেখিয়া বলিল–আরে এসো হাজারি-দা, বড্ড বেলা করলে যে! বড় ডেকে ভাতটা চাপাও– নেবে নাকি একটু দম দিয়ে?
–তা নাও না? সাজো গিয়ে–আমি ডাল দেখচি—
একটু পরে গাঁজার কলিকাটি হাজারির হাতে দিয়া বংশী বলিল–একটা বড় কাজেয় বায়না এসেছে, নেবে? আন্দুলের ঘোষেদের বাড়ী রাস হবে-সাতদিনের ঠিকে কাজ। বঁদে ভিয়েন, সন্দেশ ভিয়েন, রান্না এই সব। দু’টাকা মজুরি দিন–খোরাকি বাদে।
হাজারি বলিল–বংশী একটা কথা বলি তোমায়। আমি হোটেল খুলছি রাণাঘাটের বাজারে। কাউকে বোলো না কথাটা। তোমাকে আসতে হবে আমার হোটেলে।
কথাটা ঠিক শুনিয়াছে বলিয়া বংশীর যেন মনে হইল না। সে অবাক হইয়া উহার দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল–হোটেল খুলবে? তুমি।?
–হাঁ, আমি না কে? তোমার বেহাই?
বংশী বলিল–কি পাগলের মত বলছ হাজারি-দা? কলকে রাখো, আর টান দিও না। রেলবাজারে একটা হোটেল খুলতে কত টাকা লাগে তুমি জানো?
–কত টাকা বলে তোমার মনে হয়?
–পাঁচশো টাকার কম নয়।
–চারশোতে হয় না?
–আপাততঃ চলবে–কিন্তু কে তোমায় চারশো টাকা–
উত্তরে কোঁচার কাপড়ের গেরো খুলিয়া হাজারি বংশীকে নোটের তাড়া দেখাইয়া বলিল এই দেখছো তো দুশো টাকা এতে আছে। যোগাড় করে এনেছি। এখন লাগো গাছকোমর বেঁধে–তোমার অংশ থাকবে যদি প্রাণপণে চালাতে পারো–তোমায় ফাঁকি দেবো না। আজ থেকেই বাড়ী দেখ–পনেরো টাকা পর্যন্ত ভাড়া দেবো–আর দুশো টাকাও যোগাড় আছে।
বংশী ঠাকুর মুখের মধ্যে একটা অস্পষ্ট শব্দ কবিয়া বলিল–ভ্যালা আমার মানিক রে। হাজারি-দা, এসো তোমায় কোলে করে নাচি। এক অস্ত্রে বেচু চক্কত্তি বধ, পদ্মদিদি বধ, যদু বাঁড়ুয্যে বধ–
–চুপ, চুপ,–চলো ছুটির পর দুজনে ঘর দেখা যাক। তামাকের দোকানের পাশে ওই ঘরখানা ন’টাকা ভাড়া বলে। জায়গাটা ভাল। আচ্ছা, বাজার কেমন, বংশী?
–বাজার ভালো। নতুন আলু সস্তা হোলে আরও সুবিধে হবে। নতুন আল উঠলো বলে। কেবল মাছটা এখনও আক্রা–
–ঘর দেখার পর একটা ফর্দ করে ফেলা যাক এসো। থালা বাসন, বালতি, জালা, শিলনোড়া, বঁটি–
–আজ খাওয়াও হাজারি-দা। মাইরি, একটা কাজের-মত কাজ করলে। আচ্ছা টাকা পেলে কোথায় বল না?
–পরে বলব সব। তার ঢের সময় আছে। এখন আগেকার কাজ আগে করো।
পদ্মঝি হঠাৎ রান্নাঘরে ঢুকিয়া বলিল–বেশ তো দুটিতে বসে খোসগল্প চলছে। উদিকে মাছ ডাঙায়, তরকারি ডাঙায়–এখুনি লোক খেতে আসবে—
গোবরা চাকর হাঁকিল–থাড কেলাস একথালা–
পদ্মঝি বলিল—ওই! এলো তো? এখন মাছ ভাজা পৰ্যন্ত হোল না যে তাই দিয়ে ভাত দেবে। এদিকে গাঁজার ধোঁয়ায় তো রান্নাঘর অন্ধকার–সব তাড়াতে হবে তবে হোটেল চলবে। কর্তার খেয়েদেয়ে নেই কাজ তাই যত হাড়হাভাতে উনপাঁজুরে গাঁজাখোর আবার জুটিয়ে এনে হাতাবেড়ি হাতে দিয়েছে–
বংশী ঠাকুর বলিল–রাগ করো কেন পদ্মদিদি, কাল রাতের বাসি মাছ ভেজে রেখেছি– থাড কেলাসের খদ্দের যারা সকালে খায়, তাই চিরকাল খেয়ে আসছে।
হাজারি বংশীর দিকে চাহিয়া বলিল–না বংশী দই এনে দাও সেও ভাল। বাসি মাছ দিও না–ওতে নাম খারাপ হয়ে যায়–ও থাক।
পদ্মঝি ঝাঁজের সহিত বলিল–দইয়ের পয়সা তুমি দিও তবে ঠাকুর। হোটেল থেকে দেওয়া হবে না। তুমি বেলা করে বাড়ী থেকে এলে বলেই মাছ হোল না। বংশী ঠাকুর একা কত দিকে যাবে?
হাজারি চুপ করিয়া রহিল।
হোটেলের ছুটির পর হাজারি চূর্ণীঘাটে যাইবার পথে রাধাবল্লভতলায় বার বার নমস্কার করিয়া গেল। ঠাকুর রাধাবল্লভ এতদিন পরে যেন মুখ তুলিয়া চাহিয়াছেন। তাহার সেই প্রিয় গাছটির তলায় বসিয়া হাজারি কত কি কথা ভাবিতে লাগিল। অতসী টাকা দিয়া দিয়াছে, তাহার বাড়ী বহিয়া আসিয়া টাকা দিয়া গিয়াছে–হয়তো সে হোটেল খুলিতে দেরি করিত, কিন্তু আর দেরি করা চলিবে না। অতসী-মায়ের কাছে কথা দিয়াছে, সেকথা রাখিতে হইবেই তাহাকে।
রাণাঘাট বেশ লাগে তাহার, বেচুবাবুর হোটেল তো একমাত্র জায়গা যেখানে তাহার মন ভাল থাকে, জীবনটা শান্তিতে কাটাইতেছি বলিয়া মনে হয়। এই রাণাঘাটের রেলবাজার ছাড়িয়া সে কোথাও যাইতে পারিবে না। এখানেই হোটেল খুলিবে, অন্যত্র নয়।
বৈকালের দিকে সে কুসুমের বাড়ী গেল। কুসুম বলিল–আজকে এলেন? আসুন, বসুন।
হাজারি হাসিমুখে বলিল–একটা জিনিস রাখতে হবে মা।
–কি?
হাজারি পেট-কোঁচড় হইতে দু’শো টাকার নোট বাহির করিয়া বলিল–রেখে দাও।
কুসুম অবাক হইয়া বলিল–কোথায় পেলেন?
–ভগবান দিয়েছেন। হোটেল খুলবার রেস্ত জুটিয়ে দিয়েছেন এতদিন পরে–এই দু’শো, আর তোমার দু’শো, সামনের মাসেই খুলবো ভাবছি।
–এ টাকা কে দিলে জ্যাঠামশায় বললেন না আমায়?
–তোমার মত আর একটি মা।
–আমি চিনিনে?
–আমাদের গাঁয়ের বাবুর মেয়ে অতসী। বলবো সে সব কথা আর একদিন, আজ বেলা যাচ্ছে, আমি গিয়ে ডেক চাপাই গে–টাকা রেখে দাও এখন।
হোটেলে আসিয়া বংশীকে বলিল–তোমার ভাগ্নেটিকে চিঠি লিখে আনাও বংশী। তাকে গদিতে বসতে হবে। লেখাপড়ার কাজ তো আমায় বা তোমায় দিয়ে হবে না।