পদ্ম বলিল–কেন আসাম মেল–
–আসাম মেলে আর তেমন খদ্দের আসছে কই? আগে আগে আসাম মেলে আটটা দশটা খদ্দের ফি দিন পাওয়া যেত–কি যে হয়েছে বাজারের অবস্থা–
পদ্ম ঝি ভিতরে গিয়া রসুয়ে-বামুনের নিকট হইতে টিকিট আনিয়া বলিল–শোনো মজা, ফাস্টো কেলাসের ডাল যা ছিল সব সাবাড়। হাজারি ঠাকুরের কাণ্ড! ইদিকে এই খদ্দের বাবু গিয়ে তাকে একেবারে স্বগ্গে তুলে দিচ্ছে, তুমি হেনো রাঁধো, তুমি তেমন রাঁধো বলে–যত অনাছিষ্টি কাণ্ড, যা দেখতে পারি নে তাই। এখন ডালের কি করবে বলো–
–ডাল কতটা আছে দেখলি?
–লবডঙ্কা। আর মেরেকেটে তিন জনের মত হবে—
–ক’জনের মত ডাল দিইছিলি?
–দশ জনের মত মুগের ডাল আলাদা ফাস্টো কেলাসের মুড়িঘণ্টের জন্যে দিইছি-সেকেন কেলাসে ত্রিশ জনের মুসুরি-খেঁসারি মিশেল ডাল–
–হাজারি ঠাকুরকে ডেকে দে—
পদ্ম ঝি হাজারি ঠাকুরকে সঙ্গে করিয়াই আনিল।
লোকটার বয়স পঁয়তাল্লিশ-ছে’চল্লিশ, একহারা চেহারা, রং কালো। দেখিলে মন হয় লোকটা নিপাট ভালমানুষ।
বেচু চক্কত্তি বলিল–হাজারি ঠাকুর, ডাল কম হ’ল কি করে?
হাজারি ঠাকুর বলিল–তা কি করে বলবো বাবু? রোজ যেমন ডাল খদ্দেরদের দিই, তার বেশী তো দিই নি। কম হলে আমি কি করবো বলুন।
পদ্ম ঝি ঝঙ্কার দিয়া বলিল–তোমার হাড়ে হাড়ে বদমাইশি ঠাকুর। আমি পষ্ট দেখেছি তুমি ওই খদ্দের বাবুদের মুখে রান্নার সুখ্যাতি শুনে তাদের পাতে উড়কি উড়কি মুড়িঘণ্ট ঢালছো। পয়সা-কড়িও দিয়েছে বোধ হয় বকশিশ–
হাজারি বলিল–বকশিশ এ হোটেলে কত পাই দেখছো তো পদ্মদিদি। একটা বিড়ি খেতে কেউ দ্যায়–আজ পাঁচ বছর এখানে আছি? তুমি কেবল বকশিশ পেতে দ্যাখো আমাকে।
পদ্ম বলিল–তুমি মুখে-মুখে তককো ক’রো না বলে দিচ্ছি। পদ্ম ঝি কাউকে ভয় করে কথা বলবার মেয়ে নয়। ফাস্টো কেলাসের বাবুরা পুজোর সময় তোমায় গেঞ্জি কিনে দেয় নি?
–ইস-ভারী গেঞ্জি একটা কিনে দিয়েছিল বুঝি, পুরনো গেঞ্জি–
বেচু চক্কত্তি বলিল–যাও যাও, ঠাকুর, বাজে কথা নিয়ে বকো না। বেশী খদ্দের আসে, ডালের দাম তোমার মাইনে থেকে কাটা যাবে।
–কেন বাবু আমার কি দোষ হ’ল এতে। পদ্মদিদি আট জনের ডাল মেপে দিয়েছে, তাতে খেয়েছে এগারো জন–
পদ্ম এবার হাজারি ঠাকুরের সামনে আসিয়া হাত-মুখ নাড়িয়া চোখ পাকাইয়া বলিল–আট জনের ডাল মেপে দিইছি–নচ্ছার, বদমাইশ, গাঁজাখোর কোথাকার–দশ জনের দশের অর্ধেক পাঁচ পোয়া ডাল তোমায় দিই নি বের করে?
হাজারি ঠাকুর আর প্রতিবাদ করিতে বোধ হয় সাহস পাইল না।
পদ্ম ঝি অত অল্পে বোধ হয় ছাড়িত না–কিন্তু ইতিমধ্যে খদ্দেররা আসিয়া পড়াতে সে কথা বন্ধ করিয়া চলিয়া গেল। হাজারি ঠাকুরও ভিতরে গেল।
বেলা প্রায় আড়াইটা।
আসাম মেল অনেকক্ষণ আসিয়া চলিয়া গিয়াছে।
হাজারি ঠাকুর একা খাওয়ার ঘরে খাইতে বসিল। বড় ডেকচিতে দুটিখানি মাত্র ভাত ও কড়ায় একটুখানি ঘাঁটা তরকারি পড়িয়া আছে। ডাল, মাছ যাহা ছিল, পদ্ম ঝিকে তাহার বড় থালায় বাড়িয়া দিতে হইয়াছে–সে রোজ বেলা দেড়টার সময় রান্নাঘরের উদ্বৃত্ত ও ডাল তরকারি মাছ নিজের বাসায় লইয়া যায়–রসুয়ে-বামুনদের জন্যে কিছু থাকুক আর না থাকুক।
অন্য রসুয়ে-বামুনটা উড়িয়া। তার নাম রতন ঠাকুর। সে হোটেলে বসিয়া খায় না– তাহারও বাসা নিকটে। সেও ভাত-তরকারি লইয়া যায়।
হাজারির এখানে কেহ নাই। সে হোটেলেই থাকে, হোটেলেই খায়। রোজই তার ভাগ্যে এই রকম। বেলা আড়াইটা পর্যন্ত খালি পেটে খাটিয়া দুটি কড়কড়ে ভাত, কোনোদিন সামান্য একটু ডাল, কোনোদিন তাও না–ইহাই তাহার বরাদ্দ। ডেকচিতে বেশী ভাত থাকিলে পদ্ম ঝি বলিবে–অত ভাত খাবে কে? ও তো তিন জনের খোরাক–আমার থালায় আর দুটো বেশী করে ভাত বেড়ে দিও।
হাজারি ঠাকুর খাইতে বসিয়া রোজ ভাবে–আর দুটো ভাত থাকলে ভাল হোত, না-হয় তেঁতুল দিয়ে খেতাম। পদ্মটা কি সোজা বদমাইশ মাগী-পেট ভরে যে কেউ খায়-তাও তার সহ্যি হয় না। যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলে বেলা এগারোটার সময় রাঁধুনি-বামুন একথালা ভাত খেয়ে নেয়, আমাদের এখানে তা হবার জো আছে? বাব্বা, যেমন কর্তা, তেমনি গিন্নি (পদ্ম ঝিকে মনে মনে গিন্নি বলিয়া হাজারি ঠাকুর খুব আমোদ উপভোগ করিল–মুখ ফুটিয়া যাহা বলা যায় না, মনে মনে তাহা বলিয়াও সুথ।)।
খাওয়ার পরে মাত্র আড়াই ঘণ্টা ছুটি।
আবার ঠিক বেলা পাঁচটায় উনুনে ডেকচি চাপাইতে হইবে।
.
রতন ঠাকুর এই সময়টা বাসায় গিয়া ঘুমোয়, কিন্তু হাজারি ঠাকুর চূর্ণী নদীর ধারের ঠাকুর বাড়ীতে, কিংবা রাধাবল্লভ-তলায় নাটমন্দিরে একা বসিয়া কাটায়।
না ঘুমাইয়া একা বসিয়া কাটাইবার মানে আছে।
হাজারি ঠাকুরের এই সময়টা হইতেছে ভাবিবার সময়। এ সময় ছাড়া আর নির্জনে ভাবিবার অবসর পাওয়া যায় না। সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকিতে হয়, রাত এগারটা পর্যন্ত খদ্দেরদের পরিবেশন, রাত বারোটা পর্যন্ত নিজেদের খাওয়া-দাওয়া, তার পর কর্তার কাছে চাল-ডালের হিসাব মিটানো। রাত একটার এদিকে শুইবার অবসর পাওয়া যায় না, দু-দণ্ড একা বসিয়া ভাবিবার সময় কই?
চূর্ণী নদীর ধারের জায়গাটি বেশ ভাল লাগে।
ও-পারে শান্তিপুর যাইবার কাঁচা সড়ক। খেয়া নৌকায় লোকজন পারাপার হইতেছে। গ্রামের বাঁশবন, শিমুল গাছ, মাঠ, কলাই ক্ষেত, গাবতেরেণ্ডার বেড়া-ঘেরা গৃহস্থ-বাড়ী।