–মেয়ের বিয়ে দেবে?
–আজ্ঞে না বাবু, তা নয়, ব্যবসা করবো।
–কি ব্যবসা?
–বাবু আপনি তো জানেন আমি হোটেলে কাজ করি। আপনার কাছে লুকোবে না। আমি নিজে একটা হোটেল খুলতে চাচ্ছি এবার। টাকাটা সেজন্যে দরকার।
–কত টাকা দরকার?
–অন্তত দুশো টাকা আমায় যদি দয়া করে দেন বাবু, আমার খালধারের কাঁঠাল বাগান আমি বন্ধক রাখচি আপনার কাছে। এক বছরের মধ্যে টাকাটা শোধ করবে।
হরিচরণবাবু ভাবিয়া বলিলেন–বাগান বন্ধক রেখে টাকা আমি দিতাম না, দিতাম তো তোমাকে এমনি দিতাম, কিন্তু অত টাকা এমন সময় আমার হাতে নগদ নেই।
হাজৰি এ-কথার পরে আর কোনো কথা বলিতে পারিল না, বিশেষত সে জানিত হরিচরণবাবু উদার মেজাজের মানুষ, সত্যবাদী লোক। টাকা হাতে থাকিলে, হাতে টাকা না থাকার কথা বলিতেন না।
অতলী আসিয়া বলিল–কাকা, আপনি একটু বসুন। টেঁপি খেতে বলেছে, মা ছাড়বে না। মেয়েরা, যারা গান শুনতে এসেছিল, সবাইকে না খাইয়ে যেতে দেবেন না। একটু দেরি হবে। না হয় আপনি যান, আমি ঝি’র সঙ্গে পাঠিয়ে দেব এখন। হরিচরণবাবু বলিলেন –তোমার যদি বিশেষ কাজ না থাকে, একটু বসে যাও না হাজারি। তোমার সঙ্গে দুটো কথা কই। কেউ বড় একটা আসে না আমার এখানে–। হাজারি বসিল।
–তুমি কোথায় কোন হোটেলে কাজ কর?
–আজ্ঞে রাণাঘাট, বেচু চক্কত্তির হোটেলে, রেল-বাজারের মধ্যে।
–কত মাইনে পাও?
–বাবু সে আর বলবার কথা নয়, খাওয়া আর সাত টাকা মাসে। তাই ভাবছিলাম পরের তাঁবে থাকবে না। এদিকে বয়স হলো, এইবার একটা হোটেল খুলে নিজে চালাবো।
–হোটেল চালাতে পারবে?
–তা বাবু আপনার আশীর্বাদে একরকম সবই জানি ও-লাইনের। বাজার আর রান্না, হোটেলের দুটো মস্ত কাজ, এ যে শিখেচে, সে হোটেল খুলে লাভ করতে পারে। আমি অনেকদিন থেকে চেষ্টা করে ও দুটো কাজ শিখে নিইচি–খদ্দের কি চায় তাও জানি। চাকরি করি রাঁধুনীর বটে বাবু কিন্তু আপনার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে, আপনার আশীর্বাদে চোখ-কান খুলে কাজ করি।
–বেশ ভাল।
উৎসাহ পাইয়া হাজারি তাহার বহুদিনের আশা ও সাধ একটি আদর্শ হিন্দু হোটেল প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে অনেক কথা বলিল। চূর্ণীনদীর ধারে বসিয়া অবসর মুহূর্তে তাহার সে স্বপ্ন দেখার কথাও গোপন করিল না। তাহার রান্না খাইয়া কলিকাতার বাবুরা কি রকম সুখ্যাতি করিয়াছে, যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলে তাহাকে ভাঙ্গাইয়া লইবার চেষ্টা, কিছুই বাদ দিল না। হরিচরণবাবু বলিলেন–দেখ হাজারি, তোমার কথা শুনে তোমার ওপর আমার হিংসে হয়। তোমার বয়েস হোলে কি হবে, তোমার জীবনে মস্ত বড় আশা রয়েছে একটা কিছু গড়ে তুলবো। এই আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, আমার ছেলেটা মারা যাওয়ার পর আমার জীবনে যেন সব-কিছু ফুরিয়ে গিয়েছে মনে হয়। আর যেন কিছু করবার নেই, ক’রে কি হবে, কার জন্যে করবো এই সব কথা মনে ওঠে। তা ছাড়া জীবনে কখনোই কিছু দরকার হয়নি। বাবার সম্পত্তি ছিল যথেষ্ট–নতুন কিছু গড়ে তুলবো এ ইচ্ছে কোনদিন জাগেনি। তোমার বয়েস হোলে কি হবে, ওই একটা আশাই তোমায় যুবক করে রেখে দেবে যে! আমার মাথায় এত পাকা চুল ছিল না। খোকা মারা যাওয়ার পরে জীবনের উদ্যম, আশা ভরসা যেমন চলে গেল, অমনি মাথার চুল পেকে উঠলো। তবে এখন ইচ্ছে আছে খোকার নামে একটা স্কুল করে দেবো। আবার ভাবি, স্কুলে পড়বেই বা কে? আমাদের এ অঞ্চলে তো লোকের বাস নেই। তার চেয়ে না হয় একটা ডাক্তারখানা করে দিই। উদ্যমই জীবনের সবটুকু, যার জীবনে আশা নেই, যা কিছু করার ছিল সব হয়ে গেছে–তার জীবন বড় কষ্টকর। যেমন ধরো দাঁড়িয়েচে আমার। খোকা মারা না গেলে আজ আমার ভাবনা হে হাজারি! ভেবেছিলুম কয়লার খনি ইজারা নেবো–কত উৎসাহ ছিল। এখন মনে হয় কার জন্যে করবো? তাই বলচিলুম, তোমায় দেখে হিংসে হয়। তোমার জীবনে উদ্যম আছে, আশা আছে–আমার তা নেই। আর এই দেখ, এই পাড়াগাঁয়ে একলাটি আছি পড়ে, ভালো লাগে কি? ভালো লাগে না। কখনো থাকিনি, কিন্তু বাইরে আর হৈ-চৈ-এর মধ্যে থাকতে ভাল লাগে না। ওই মেয়েটা আছে, কলের গান এনেচে একটা– বাজায়, আমি শুনি। ওর মায়ের জন্যে বেছে বেছে ভক্তি আর দেহতত্ত্বের গান কিনে দিইচি, যদি তা শুনে তার মনটা একটু ভাল থাকে। মেয়েমানুষ, কষ্টটা লেগেছে তার অনেক বেশী।
হাজারি এই দীর্ঘ বক্তৃতার সবটা তেমন বুঝিল না–কেবল বুঝিল, পুত্রশোকে বৃদ্ধের মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে।
সে সহানুভূতিসূচক দু-চার কথা বলিল। বেশী কথা অনেকক্ষণ ধরিয়া গুছাইয়া বলিতে কখনো সে শেখে নাই, তবুও পুত্রশোকাতুর বৃদ্ধের জন্য তাহার সত্যকার দুঃখ হওয়াতে, ভাবিয়া ভাবিয়া মনে মনে বানাইয়া কিছু বলিল।
হরিচরণবাবু বলিলেন–আর একটু চা খাবে?
–আজ্ঞে না। চা খাওয়া আমার তেমন অভ্যাস নেই, আপনি খান বাবু।
এমন সময় টেঁপি আসিয়া বলিল–বাবা, যাবে?
হাজারি হরিচরণবাবুর কাছে বিদায় লইয়া মেয়েকে সঙ্গে করিয়া বাহির হইল। জ্যোৎস্না উঠিয়াছে, ভড়েদের বাড়ীর উঠানে রাঙাকাঠ কাটিয়াছে–রাঙাকাঠের গন্ধ বাহির হইতেছে। সিধু ভড় দাওয়ায় জাল বুনিতেছিল, বলিল–দা-ঠাকুর কনে ছেলেন এত রাত অবদি?
হাজারি বলিল–বাবুর বাড়ী। বাবু ছাড়েন না কিছুতে, চা খাও, কলের গান শোন, শেষে তো টেঁপিকে না খাইয়ে ছাড়লেন না গিন্নী মা। হাজারির বড় ভাল লাগিয়াছিল আজ সন্ধ্যাটা। বড় লোকের বৈঠকখানায় এমন ভাবে বসিয়া চা সে কখনো খায় নাই, খাতির করিয়া তাহার সঙ্গে কোনো বড় লোকে মনের কথাও কখনো বলে নাই। কলের গান তো আছেই। মেয়েকে বলিল–টেঁপি কি খেলি রে? টেঁপি একটু ভোজনপ্রিয়। খাইতে ভালবাসে আর গরীবের মেয়ে বলিয়াই অতসীর মা তাহাকে না খাওয়াইয়া ছাড়েন না। বলিল–পরোটা, মাছের ডালনা, সুজি, পটলভাজা, আলুভাজা–