সন্ধ্যার পর সাহসে ভর করিয়া হাজারি হরিচরণবাবুর পৈতৃক আমলের বৈঠকখানার উঠানে গিয়া দাঁড়াইল। বৈঠকখানা বাড়ীর সামনে বড় বড় থামওয়ালা সাদা মার্বেল পাথর বাঁধানো বারান্দা। বারান্দার সামনে একটা মাঝারি গোছের কামরা, পাশে একটা ছোট কামরা, পূর্বে নবীনবাবু বলিয়া ইহাদের এক সরিক বড় বৈঠকখানার পাশে পৃথক ভাবে নিজের জন্য আর একটি বৈঠকখানা তৈরী করিয়াছিলেন–তিনি আজ পঁচিশ বৎসর হইল নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাওয়াতে, উক্ত বৈঠকখানা ঘর বর্তমানে বিচালি রাখিবার জন্য ব্যবহৃত হয়।
হাজারি টেঁপিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিল। টেঁপি বলিল–বাবা তুমি বোসো, আমি অতসী-দিকে বলিগে তুমি এসেছ কলের গান শুনতে। এখুনি দেবে গান।
বৈঠকখানার সামনে হাজারিকে দাঁড় করাইয়া রাখিয়া টেঁপি পাশের ছোট্ট দরজা দিয়া বাড়ীর মধ্যে সরিয়া পড়িল।
ঘরের মধ্যে তেলের চৌপায়া লণ্ঠন জ্বলিতেছে। ইহা সাবেকী কালের বন্দোবস্ত, এখনও ঠিক বজায় আছে। হাজারি বারান্দায় দাঁড়াইয়া ইতস্ততঃ করিতেছে ঘরে ঢুকিবে কিনা, এমন সময় ঘরের ভিতর হইতে স্বয়ং হরিচরণবাবু বারান্দায় বাহির হইয়াই সামনে হাজারিকে দেখিয়া বলিলেন–কে?
হাজারি বিনীত ভাবে হাত জোড় করিয়া মাথা নীচু করিয়া প্রণাম করিয়া বলিল–বাবু, আমি হাজারি—
–ও, হাজারি! কি মনে করে, এসো এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ঘরের মধ্যে এসো। মাস-দুই তোমায় দেখিনি। তোমার মেয়ে মাঝে মাঝে আসে বটে, আমার বড় মেয়ে অতসীর সঙ্গে তার বেশ ভাব।
হরিচরণবাবুর বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হইবে, গৌরবর্ণ, লম্বা আড়ার চেহারা, বড় বড় চোখ –গলার স্বর গম্ভীর। তিনি খুব শৌখীন লোক ছিলেন। এখনও এই বয়সেও এবং ছেলে মারা যাওয়া সত্ত্বেও বেশ শৌখীনতা ও সুরুচির পরিচয় আছে তার আটপৌরে পোশাকেও।
হাজারি আসলে আসিয়াছে টাকা ধার করিবার কথা বলিতে। কিন্তু বৈঠকখানা ঘরে ঢুকিয়া প্রকাণ্ড বড় সেকেলে প্রমাণ সাইজের আয়নাখানায় নিজের আপাদ-মস্তক দেখিয়াই তাহার সাহসটুকু সব উবিয়া গেল।
হরিচরণবাবুর নির্দেশ মত সে একখানা চেয়ারে বসিল।
হরিচরণবাবু বলিলেন–চা খাবে হাজারি?
হাজারি আমতা আমতা করিয়া বলিল–আজ্ঞে, চা আমি–থাকগে, সে কেন আবার কষ্ট–
হরিচরণবাবু বলিলেন–বিলক্ষণ! কষ্ট কিসের? আমি তো চা খাবোই এখন, দাঁড়াও আনতে বলি
এই সময় টেঁপি বৈঠকখানার যে দোর অন্তঃপুরের দিকে, সেখানে আসিয়া দাঁড়াইল। হরিচরণবাবুকে বৈঠকখানার মধ্যে দেখিয়াও সে বেশ সহজ ভাবেই বলিল–বাবা দাঁড়াও, অতসী-দি কলের গান বাজাচ্চে-আমি বলেছি আমার বাবা তোমাদের কলের গান শুনতে এসেচে
হরিচরণ বাবু বলিয়া উঠিলেন–কলের গান শুনতে এসেচ হাজারি! তা আমাকে বলতে হয় এতক্ষণ। শুনতে আসবে এর আর কথা কি? তোমরা দু-পাঁচজন আস-ধাও, বড় আনন্দের কথা। গ্রাম তো লোকশূন্য হয়ে পড়েচে। ওরে খুকি, তোর বাবার জন্যে আর আমার জন্যে দু’ পেয়ালা চা আনতে বলে দে তোর অতসী-দিদিকে।
হাজারি মনে মনে টেঁপির উপর চটিয়া গেল। হতভাগা মেয়েটা সব দিল মাটি করিয়া। কে তাহাকে বলিয়াছিল কলের গান শুনিতে সে যাইতেছে মুখুয্যে বাড়ীতে? অতঃপর টাকার কথা উত্থাপন করা কি ভালো দেখায়? নাঃ, যত ছেলেমানুষ নিয়া হইয়াছে কারবার!
হরিচরণবাবুর মেয়ে অতসী এই সময় দু’ পেয়ালা চা-হাতে ধরে ঢুকিল। প্রথমে হাজারি সামনে টেবিলে একটি পেয়ালা নামাইয়া অন্য পেয়ালাটি হরিচরণবাবুর হাতে দিল। অতসীয় বয়স আঠারো-উনিশ, বেশ ধপধপে ফর্সা, সুন্দর মুখশ্রী–ডাগর ডাগর চোখ–এক কথায় অতসী সুন্দরী মেয়ে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অথচ সহজ অনাড়ম্বর সাজগোজ, হাতে কয়েক গাছি সরু সোনার চুড়ি এবং কানে ইয়ারিং ছাড়া অলঙ্কারেরও কোন বাহুল্য নাই।
হরিচরণবাবু বলিলেন–তোমার হাজারি কাকা–প্রণাম কর অতসী।
অতলী আগাইয়া আসিয়া হাজারির সামনে নীচু হইয়া প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইল। হাজারি সঙ্কুচিত হইয়া বলিল–থাক থাক এসো মা, রাজরাণী হও মা–এসো, কল্যাণ হোক।
অতসীকে হরিচরণবাবু বলিলেন–তোমার হাজারি কাকা গান শুনবেন। গ্রামোফোনটা নিয়ে এসো।
অতসীর সঙ্গে টেঁপি খুব ভাব করিয়াছে। টেঁপির বাবাকে অতসী এই প্রথম– দেখিল বন্ধুর পিতা কি রকম দেখিতে, কৌতূহলের সহিত সে চাহিয়া দেখিতেছিল, বাবার কথায় বাড়ীর মধ্যে চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে চাকরের হাতে দিয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের বার বাহিরে পাঠাইয়া দিল।
হরিচরণবাবু চাকরকে বলিলেন বাজাবে কে? তোর দিদিমণি আসছে না?
–দিদিমণি যে বল্লেন আপনি বাজাবেন–
–আমি ভাল চোখে দেখতে পাব না। তাকেই পাঠিয়ে দিগে যা– একটু পরে অতসী, টেঁপি এবং পাড়ার আরও দু-তিনটি মেয়ে ঘরে ঢুকিল। কলের গান বাজনা শুরু হইল এবং চলিল ঘণ্টা-দুই। আরও একবার চা দিয়া গেল চাকরে, কিন্তু পরিবেশন করিল অতসী।
সব মিটিয়া চুকিয়া যাইতে রাত্রি প্রায় সাড়ে ন’টা বাজিয়া গেল। হাজারি ছটফট করিতেছিল, গান শুনিতে সে এখানে আসে নাই।
গান বন্ধ হইলে অতসী, টেঁপি ও মেয়ের দল যখন বাড়ীর মধ্যে চলিয়া গেল, তপন হাজারি সাহসে ভর করিয়া বলিল–আপনার কাছে একটা আর্জি ছিল বাবু।
হরিচরণবাবু বলিলেন–কি বল?
–আমার কিছু টাকা দরকার, যদি আমায় কিছু ধার দিতেন, তাহলে আমার একটা মস্ত বড় আশার কাজ মিটতো।