হাজারি ঠাকুর অবাক হইয়া বলিল–সাড়ে ন’টার মধ্যে ওই আধ মণ ময়দা ভেজে পাঠিয়ে দেবো, আবার হোটেলের রান্না রাঁধবো! কি যে বল পদ্মদিদি, তা কি করে হবে? রতন ঠাকুকে বল না লুচি ভেঙে দিক, আমি হোটেলের রান্না বাঁধবো।
পদ্ম ঝি চোখ রাঙাইয়া ছাড়া কথা বলে না। সে গরম হইয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিল– তোমার ইচ্ছে বা খুশিতে এখানকার কাজ চলবে না। কর্তা মশায়ের হুকুম। আমায় যা বলে গেছেন তোমায় বললাম, তিনি বড় বাজারে বেরিয়ে গেলেন–আসতে রাত হবে। এখন তোমার মর্জি–করো আর না করো।
অর্থাৎ না করিয়া উপায় নাই। কিন্তু ইহাদের এই অবিচারে হাজারির চোখে প্রায় জল আসিল। নিছক অবিচার ছাড়া ইহা অন্য কিছু নহে। রতন ঠাকুরকে দিয়া ইহারা সাধারণ রান্না অনায়াসেই করাইতে পারিত, কিন্তু পদ্ম ঝি তাহা হইলে খুশি হইবে না। সে যে কি বিষ-চক্ষে পড়িয়াছে পদ্ম ঝিয়ের! উহাকে জব্দ করিবার কোনো ফাঁকই পদ্ম ছাড়ে না।
ভীষণ আগুনের তাতের মধ্যে বসিয়া রতন ঠাকুরের সঙ্গে দৈনিক রান্না কাৰ্যেতেই প্রায় ন’টা বাজিয়া গেল। পদ্ম ঝি তাহার পর ভীষণ তাগাদা লাগাইল লুচি ভাজাতে হাত দিবার জন্য। পদ্ম নিজে খাটিতে রাজি নয়, সে গেল খরিদ্দারদের খাওয়ার তদারক করিতে। আজ আবার হাটবার, বহু ব্যাপারী খরিদ্দার। রতন ঠাকুর তাহাদের পরিবেশন করিতে লাগিল। হাজারি এক ছিলিম তামাক খাইয়া লইয়াই আবার আগুনের তাতে বসিয়া গেল লুচি ভাজিতে।
আধঘণ্টা পরে–তখন পাঁচ সের ময়দাও ভাজা হয় নাই–পদ্ম আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, লুচি হয়েছে? ওদের লোক এসেছে নিতে।
হাজারি বলিল–না এখনো হয়নি পদ্মদিদি। একটু ঘুরে আসতে বল।
–ঘুরে আসতে বললে চলবে কেন? সাড়ে ন’টার মধ্যে ওদের খাবার তৈরি করে রাখতে হবে বলে গেছে। তোমায় বলিনি সেকথা?
–বল্লে কি হবে পদ্মদিদি? মন্তরে ভাজা হবে আধ মণ ময়দা? ন’টার সময় তো উনুনে ব্ৰহ্মার নেচি ফেলেচি–জিগ্যেস করো মতিকে।
–সে সব আমি জানিনে। যদি ওরা অর্ডার ফেরত দেয়, বোঝাপড়া ক’রো কর্তার সঙ্গে, তোমার মাইনে থেকে আধ মন ময়দা আর দশ সের ঘি র দাম একমাসে তো উঠবে না, তিন মাসে ওঠাতে হবে।
হাজারি দেখিল, কথা কাটাকাটি করিয়া লাভ নাই। সে নীরবে লুচি ভাজিয়া যাইতে লাগিল। হাজারি ফাঁকি দেওয়া অভ্যাস করে নাই–কাজ করিতে বসিয়া শুধু ভাবে কাজ করিয়া যাওয়াই তাহার নিয়ম–কেউ দেখুক বা না-ই দেখুক। লুচি ঘিয়ে ডুবাইয়া তাড়াতাড়ি তুলিয়া ফেলিলে শীঘ্র শীঘ্র কাজ চুকিয়া যায় বটে, কিন্তু তাহাতে লুচি কাঁচা থাকিয়া যাইবে। এজন্য সে ধীরে ধীরে সময় লইয়া লুচি তুলিতে লাগিল। পদ্ম ঝি একবার বলিল– অত দেরি করে খোলা নামাচ্ছ কেন ঠাকুর? হাত চালাও না–অত লুচি ডুবিয়ে রাখলে কড়া হয়ে যাবে–
হাজারি ভাবিল, একবার সে বলে যে রান্নার কাজ পদ্ম ঝিয়ের কাছে তাহাকে শিখিতে হইবে না, লুচি ডুবাইলে কড়া কি নরম হয় সে ভালই জানে, কিন্তু তখনই সে বুঝিল, পদ্ম ঝি কেন একথা বলিতেছে।
দশ সের ঘি হইতে জলতি বাদে যাহা বাকী থাকিবে পদ্ম ঝিয়ের লাভ। সে বাড়ী লইয়া যাইবে লুকাইয়া। কর্তামশায় পদ্ম ঝিয়ের বেলায় অন্ধ। দেখিয়াও দেখেন না।
হাজাৰি ভাবিল, এই সব জুয়াচুরির জন্য হোটেলের দুর্নাম হয়। খদ্দেরে পয়সা দেবে, তারা কাঁচা লুচি খাবে কেন? দশ সের ঘিয়ের দাম তো তাদের কাছ থেকে আদায় হয়েছে, তবে তা থেকে বাঁচানোই বা কেন? তাদের জিনিসটা যাতে ভাল হয় তাই তো দেখতে হবে? পদ্ম ঝি বাড়ী নিয়ে যাবে বলে তারা দশ সের ঘিয়ের ব্যবস্থা করে নি।
পরক্ষণেই তাহার নিজের স্বপ্নে সে ভোর হইয়া গেল।
এই রেল-বাজারেই সে হোটেল খুলিবে। তাহার নিজের হোটেল। ফাঁকি কাহাকে বলে, তাহার মধ্যে থাকিবে না। খদ্দের যে জিনিসের অর্ডার দিবে, তাহার মধ্যে চুরি সে করিবে না। খদ্দের সন্তুষ্ট করিয়া ব্যবসা। নিজের হাতে রাঁধিবে, খাওয়াইয়া সকলকে সন্তুষ্ট রাখিবে। চুরি-জুয়াচুরির মধ্যে সে নাই।
লুচি ভাজা ঘিয়ের বুদ্বুদের মধ্যে হাজারি ঠাকুর যেন সেই ভবিষ্যৎ হোটেলের ছবি দেখিতে পাইতেছে। প্রত্যেক ঘিয়ের বুদ্বুদটাতে। পদ্ম ঝি সেখানে নাই, বেচু চক্কত্তির গাঁজাখোর ও মাতাল শালাও নাই। বাহিরে গদির ঘরে দিব্য ফর্সা বিছানা পাতা, খদ্দের যতক্ষণ ইচ্ছা বিশ্রাম করুক, তামাক খাইতে ইচ্ছা করে থাক, বাড়তি পয়সা আর একটিও দিতে হইবে না। দুইটা করিয়া মাছ, হপ্তায় তিন দিন মাংস বাঁধা-খদ্দেরদের। এসব না করিয়া শুধু ইষ্টিশনের প্লাটফর্মে–হি-ই-ইন্দু হোটেল, হি-ই-ই-ন্দু হোটেল, বলিয়া মতি চাকরের মত চেঁচাইয়া গলা ফাটাইলে কি খদ্দের ভিড়িবে?
পদ্ম ঝি আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, তোমার হোল? হাত চালিয়ে নিতে পাচ্ছ না? বাবুদের নোক যে বসে আছে।
বলিয়াই ময়দার বারকোশের দিকে চাহিয়া দেখিল, বেলা লুচি যতগুলি ছিল, হাজারি প্রায় সব খোলায় চাপাইয়া দিয়াছে–খান পনেরো কুড়ির বেশী বারকোশে নাই। মতি চাকর পদ্ম ঝিকে আসিতে দেখিয়া তাড়াতাড়ি হাত চালাইতে লাগিল।
পদ্ম ঝি বলিল–তোমার হাত চলচে না, না? এখনো দশ সের ময়দার তাল ডাঙায়, ওই রকম করে লুচি বেললে কখন কি হবে?
হাজারি বলিল–পদ্মদিদি, রাত এগারোটা বাজবে ওই লুচি বেলতে আর এক হাতে ভাজতে। তুমি বেলবার লোক দাও।