হ্যাঁ, চিনিতে পারিয়াছিল। কত কাঁদিল, চোখের জল ফেলিল, বাপ-মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করিল। অনুরোধ করিল যেন এসব কথা দেশে গিয়া সে না বলে। বাপ-মা শুনিয়া কষ্ট পাইবে। সে বেশ সুখে আছে। কপালে যাহা ছিল, তাহা হইয়াছে।
সঙ্গীটি উপসংহারে বলিল, বামুন-বাড়ির বৌ, হর্তেলের মতো গায়ের রঙ-যেন ঠাকরুনের পিরতিমে!
দুর্গ-প্রতিমার মতো রূপসী একটি গৃহস্থবধূ ছেঁড়া কাপড় পরনে, শামুকপোতার বিলে হাঁটুজল ভাঙিয়া চুপড়ি হাতে গুগলি তুলিতেছে-কত কাল ছবিটা তাহার মনে ছিল!
সেদিন সে স্কুলে গিয়া দেখিল স্কুলসুদ্ধ লোক বেজায় সন্ত্রস্ত! মাস্টারেরা এদিক ওদিক ছুটািছুটি করিতেছেন। স্কুল-ঘর গাঁদা ফুলের মালা দিয়া সাজানো হইতেছে, তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় খামোখা একটি সুবৃহৎ সিঁড়ি-ভাঙা ভগ্নাংশ কষিয়া নিজের ক্লাসের বোর্ড পুরাইয়া রাখিয়াছেন। হঠাৎ আজ স্কুল-ঘরের বারান্দা ও কম্পাউন্ড এত সাফ করিয়া রাখা হইয়াছে যে, যাহারা বারোমাস এস্থানের সহিত পরিচিত, তাহদের বিস্মিত হইবার কথা। হেডমাস্টার ফণীবাবু খাতপত্র, অ্যাডমিশন বুক, শিক্ষকগণের হাজিরা বই লইয়া মহা ব্যস্ত। সেকেন্ড পণ্ডিতকে ডাকিয়া বলিলেন, ও অমূল্যবাবু, চৌঠে তারিখে খাতায় যে নাম সই করেন নি? আপনাকে বলে বলে আর পারা গেল না। দেরিতে এসেছিলেন তো খাতায় সই করে ক্লাসে গেলেই হত? সব মনে থাকে, এইটের বেলাতেই
অপু শুনিল একটার সময় ইন্সপেক্টর আসিবেন স্কুল দেখিতে। ইন্সপেক্টর আসিলে কি করিযা উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে অভ্যর্থনা করিতে হইবে, তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় ক্লাসের ছেলেদের সে বিষয়ে তালিম দিতে লাগিলেন।
বারোটার কিছু পূর্বে একখানা ঘোড়ার গাড়ি আসিয়া স্কুলের সামনে থামিল। হেডমাস্টার তখনও ফাইল দূরস্ত শেষ করিয়া উঠিতে পারেন নাই বোধ হয়-তিনি এত সকালে ইন্সপেক্টর আসিয়া পড়াটা প্রত্যাশা করেন নাই, জানাল দিয়া উঁকি মারিয়া গাড়ি দেখিতে পাইয়াই উঠি-পড়ি অবস্থায় ছুটিলেন। তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় হঠাৎ তড়িৎ স্পষ্ট ভেকের মতো সজীব হইয়া উঠিয়া তারস্বরে ও মহা উৎসাহে। (অন্যদিন এই সময়টাই তিনি ক্লাসে বসিয়া মাধ্যাহিক নিদ্রাটুকু উপভোগ করিয়া থাকেন) দ্রব পদার্থকহাকে বলে তাহার কর্ণনা আরম্ভ করিলেন। পাশের ঘরে সেকেন্ড পণ্ডিত মহাশয়ের ইকোর শব্দ অদ্ভুত ক্ষিপ্ৰতার সহিত বন্ধ হইয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার উচ্চকণ্ঠ শোনা যাইতে লাগিল। শিক্ষক বলিলেন, মতি, তোমরা অবশ্যই কমললেবু দেখিয়াছ, পৃথিবীর আকারএই হরেন-কমললেবুর ন্যায় গোলাকার–
হেডমাস্টারের পিছনে পিছনে ইন্সপেক্টর স্কুল ঘরে ঢুকিলেন। বয়স চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বৎসর হইবে, বেঁটে, গৌরবর্ণ, সাটিন জিনের লম্বা কোট গায়ে, সিল্কের চাদর গলায়, পায়ে সাদা ক্যাম্বিশের জুতা, চোখে চশমা। গলার স্বর ভারী। প্রথমে তিনি অফিস-ঘরে ঢুকিয়া খাতপত্র অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখার পরে বাহির হইয়া হেডমাস্টারের সঙ্গে ফাস্ট ক্লাসে গেলেন। অপুর বুক টিপ, টিপ করিতেছিল। এইবার তাঁহাদের ক্লাসে আসিবার পালা। তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় গলার সুর আর এক গ্রাম চড়াইলেন।
ইন্সপেক্টর ঘরে ঢুকিয়া বোর্ডের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এরা কি ভগ্নাংশ ধরেছে? তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয়ের মুখ আত্মপ্রসাদে উজ্জ্বল দেখাইল; বলিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, দু-ব্লাসে আমি অঙ্ক কাবাই কি না। ও ক্লাসেই অনেকটা এগিয়ে দিই-সরল ভগ্নাংশটা শেষ করে ফেলি
ইন্সপেক্টর এক এক করিয়া বাঙলা রিডিং পড়িতে বলিলেন। পড়িতে উঠিয়াই অপুর গলা কাঁপিতে লাগিল। শেষের দিকে তাহার পড়া বেশ ভালো হইতেছে বলিয়া তাহার নিজেরই কানে ঠেকিল। পরিষ্কার সতেজ বাঁশির মতো গলা। রিনারিনে মিষ্টি।
–বেশ, বেশ রিডিং। কি নাম তোমার?
তিনি আরও কয়েকটি প্রশ্ন করিলেন। তারপর সবগুলি ক্লাস একে একে ঘুরিয়া আসিয়া জলের ঘরে ডাব সন্দেশ খাইলেন। তৃতীয় পণ্ডিত মহাশয় অপুকে বলিলেন, তুই হাতে করে এই ছুটির দরখাস্তখানা নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাক, তোকে খুব পছন্দ করেছেন, যেমন বাইরে আসবেন, অমনি দরখাস্তখানা হাতে দিবি—দু-দিন ছুটি চাইবি-তোর কথায় হয়ে যাবে-এগিয়ে যা।
ইন্সপেক্টর চলিয়া গেলেন। তঁহার গাড়ি কিছুদূর যাইতে না যাইতে ছেলেরা সমস্বরে কলরব করিতে করিতে স্কুল হইতে বাহির হইয়া পড়িল। হেডমাস্টার ফণীবাবু অপুকে বলিলেন, ইন্সপেক্টর বাবু খুব সন্তুষ্ট হয়ে গিয়েছেন তোমার ওপর। বোর্ডের একজামিন দেওয়াব তোমাকে দিয়ে-তৈরি হও, বুঝলে?
বোর্ডের পরীক্ষা দিতে মনোনীত হওয়ার জন্য যত না হউক, ইন্সপেক্টরের পরিদর্শনের জন্য দুদিন স্কুল বন্ধ থাকিবার আনন্দে উৎফুল্প হইয়া সে বাড়ির দিকে রওনা হইল। অন্যদিনের চেয়ে দেরি হইয়া গিয়াছে। অর্ধেক পথ চলিয়া আসিয়া পথের ধারে একটা সাঁকোর উপর বসিয়া মায়ের দেওয়া খাবারের পুঁটুলি খুলিয়া বুটি, নারিকেলকোরা ও গুড় বাহির করিল। এইখানটাতে বসিয়া রোজ সে স্কুল হইতে ফিরিবার পথে খাবার খায়। রাস্তার বাঁকের মুখে সাঁকোটা, হঠাৎ কোনো দিক হইতে দেখা যায় না, একটা বড়ো তুতি-গাছের ডালপালা নত হইয়া ছায়া ও আশ্রয় দুই-ই জোগাইতেছে। সাঁকোর নিচে আমরুল শাকের বনের ধারে একটু একটু জল বাধিয়াছে, মুখ বাড়াইলেই জলে ছায়া পড়ে। অপুর কেমন একটা অস্পষ্ট ভিত্তিহীন ধারণা আছে যে, জলটা মাছে ভর্তি, তাই সে একটু একটু বুটির টুকরা উপর হইতে ফেলিয়া দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখে মাছে ঠোকরাইতেছে কি না।