মায়ের কথায় সে চুপ করিয়া গেল। চক্ৰবর্তী মহাশয় গত পৌষ মাসে কাশী চলিয়া গিয়াছেন, আজকাল তাহাকেই সমস্ত দেখিতে শুনিতে হয়। সামান্য একটু জমি-জমা আছে, তাহার খাজনা আদায়, ধান কাটাইবার বন্দোবস্তু, দশকর্ম, গৃহদেবতার পূজা। গ্রামে ব্রাহ্মণ নাই, তাহারাই একঘর মোটে। চাষি কৈবর্ত ও অন্যান্য জাতির বাস, তাহা ছাড়া এ-পাড়ার কুণ্ডুরা ও ও-পাড়ার সরকারেরা। কাজে কর্মে ইহাদের সকলেরই বাড়ি অপুকে ষষ্ঠীপূজা, মাকালীপূজা করিয়া বেড়াইতে হয়। সবাই মানে, জিনিসপত্র দেয়।
সেদিন কি একটা তিথি উপলক্ষে সরকার-বাড়ি লক্ষ্মীপূজা ছিল। পূজা সারিয়া খানিক রাত্রে জিনিসপত্র একটা পুঁটুলি বাঁধিয়া লইয়া সে পথ বাহিয়া বাড়ির দিকে আসিতেছিল; খুব জ্যোৎস্না, সরকার বাড়ির সামনে নারিকেল গাছে কাঠঠোকরা শব্দ করিতেছে। শীত বেশ পড়িয়াছে; বাতাস খুব ঠাণ্ডা, পথে ক্ষেত্র কাপালির বেড়ায় আমড়া গাছে বাউল ধরিয়াছে। কাপালিদের বাড়ির বেগুনক্ষেতের উঁচুনিচু জমিতে এক জায়গায় জ্যোৎস্না পড়িয়া চক চক করিতেছে-পাশের অন্ধকার। অপু মনে মনে কল্পনা করিতে করিতে যাইতেছিল যে, উঁচু জায়গাটা একটা ভালুক, নিচুটা জলের চৌবাচ্চা, তার পরের উঁচুটা নুনের টিবি। মনে মনে ভাবিল-কমললেবু দিয়েচে, বাড়ি গিয়ে কমলালেবুখাবো। মনের সুখে শহরে-শেখা একটা গানের একটা চরণ সে গুনগুন করিয়া ধরিল—
সাগর-কূলে বসিয়া বিরলে হেরিব লহরীমালা–
অনেকদিনের স্বপ্ন যেন আবার ফিরিয়া আসে। নিশ্চিন্দিপুরে থাকিতে ইছামতীর তীরের বনে, মাঠে কত ধূসর অপরাহ্নের কত জ্যোৎস্না-রাতের সে-সব স্বপ্ন! এই ছোট্ট চাষাগাঁয়ে চিরকালই এ রকম ষষ্ঠীপূজা মাকালীপূজা করিয়া কাঁটাইতে হইবে?
সারাদিনের রোদো-পোড়া মাটি নৈশ শিশিরে স্নিগ্ধ হইয়া আসিয়াছে, এখন শীতের রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় তাহারই সুগন্ধ।
অপুর মনে হইল রেলগাড়ির চাকায় চাকায় যেন শব্দ হয়—ছোটঠাকুর-পো-বটঠাকুরপো-ছোটুঠাকুর-পো-বটঠাকুর-পো-
দুই-এক দিনের মধ্যে সে মায়ের কাছে কথাটা আবার তুলিল। এবার শুধু তোলা নয়, নিতান্ত নাছোড়বান্দা হইয়া পড়িল। আড়বোয়ালের স্কুল দুই ক্রোশ দূরে, তাই কি? সে খুব হ্যাঁটিতে পরিবে: এটুকু। সে বুঝি চিরকাল এই রকম চাষাগায়ে বসিয়া বসিয়া ঠাকুরপূজা করিবে? বাহিরে যাইতে পাবিবে না বুঝি?
তবু আরও মাস দুই কাটিল। স্কুলের পড়াশোনা সর্বজয়া বোঝে না, সে যাহা বোঝে তাহা পাইয়াছে। তবে আবার ইস্কুলে পড়িয়া কি লাভ? বেশ তো সংসার গুছাইয়া উঠিতেছে। আর বছর কয়েক পরে ছেলের বিবাহ–তারপরই একঘর মানুষের মতো মানুষ।
সর্বজয়ার স্বপ্ন সার্থক হইয়াছে।
কিন্তু অপুর তাহা হয় নাই। তাহাকে ধরিয়া রাখা গেল না-শ্রাবণের প্রথমে সে আড়বোয়ালের মাইনর স্কুলে ভর্তি হইয়া যাতায়াত শুবু করিল।
এই পথের কথা সে জীবনের কোনোদিন ভোলে নাই-এই একটি বৎসর ধরিয়া কি অপরূপ আনন্দই পাইয়াছিল-প্রতিদিন সকালে-বিকালে এই পথ হ্যাঁটিবার সময়টাতে। …নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া অবধি এত আনন্দ আর হয় নাই।
ক্রোশ দুই পথ। দুধারে বট, তুঁতের ছায়া, ঝোপঝাপ, মাঠ, মাঝে মাঝে অনেকখানি ফাকা আকাশ। স্কুলে বসিয়া অপুর মনে হইত। সে যেন একা কতদূর বিদেশে আসিয়াছে, মন চঞ্চল হইয়া উঠিত-ছুটির পরে নির্জন পথে বাহির হইয়া পড়িত।-বৈকালের ছায়ায় ঢাঙা তাল-খেজুরগাছগুলা যেন দিগন্তের আকাশ ছুইতে চাহিতেছে-পিড়িং পিড়িং পাখির ডাক-ঘু হু মাঠের হাওয়ায় পাকা ফসলের গন্ধ আনিতেছে-সর্বত্র একটা মুক্তি, একটা আনন্দের বার্তা।…
কিন্তু সর্বাপেক্ষা সে আনন্দ পাইত পথচলতি লোকজনের সঙ্গে কথা কহিয়া। কত ধরনের লোকের সঙ্গে পথে দেখা হইত-কত দূর-গ্রামের লোক পথ দিয়া হ্যাঁটিত, কত দেশের লোক কত দেশে যাইত। অপু সবেমাত্র একা পথে বাহির হইয়াছে, বাহিরের পৃথিবীটার সহিত নতুন ভাবে পরিচয় হইতেছে, পথে ঘাটে সকলেব সঙ্গে আলাপ করিয়া তাহদের কথা জানিতে তাহার প্রবল আগ্রহ। পথ চলিবার সময়টা এইজন্য বড়ো ভালো লাগে, সাগ্রহে সে ইহার প্রতীক্ষা করে, স্কুলের ছুটির পর পথে নামিয়াই ভাবে-এইবার গল্প শুনবো। পরে ক্ষিপ্ৰপদে আগইয়া আসিয়া কোনো অপরিচিত লোকের নাগাল ধরিয়া ফেলে। প্রায়ই চাষালোক, হাতে খুঁকোকন্ধে। অপু জিজ্ঞাসা কবেকোথায় যোচ্ছ, হ্যাঁ কাক? চলো আমি মনসাপোতা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে যাবো। মামজোয়ান গিাইছিলে? তোমাদের বাড়ি বুঝি? না? শিকড়ে? নাম শুনেচি, কোনদিকে জানি নে। কি খেয়ে সকালে বেরিয়েছ, হ্যাঁ কাকা?…
তারপর সে নানা খুঁটিনাটি কথা জিজ্ঞাসা করে-কেমন সে গ্রাম, ক’ঘর লোকের বাস, কোন নদীর ধারে? ক’জন লোক তাদের বাড়ি, কত ছেলেমেয়ে, তারা কি করে?.
কত গল্প, কত গ্রামের কিংবদন্তি, সেকাল-একালের কত কথা, পল্পী-গৃহস্থের কত সুখদুঃখের কাহিনী-সে। শুনিয়াছিল এই এক বৎসরে। সে চিরদিন গল্প-পাগলা, গল্প শুনিতে শুনিতে আহার-নিদ্ৰা ভুলিয়া যায়-যন্ত সামান্য ঘটনাই হোক, তাহার ভালো লাগে। একটা ঘটনা মনে কি গভীর রেখাপাতই করিয়াছিল!
কোন গ্রামের এক ব্ৰাহ্মণবাড়ির বৌ এক বাগদীর সঙ্গে কুলের বাহির হইয়া গিয়াছিল-আজ অপুর সঙ্গীটি এইমাত্র তাকে শামুকপোতার বিলে গুগলি তুলিতে দেখিয়া আসিয়াছে। পরনে ছেঁড়া কাপড়, গায়ে গহনা নাই, ডাঙায় একটি ছোটছেলে বসিয়া আছে, বোধ হয় তাহারই। অপু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোমার দেশের মেয়ে? তোমায় চিনতে পারলে?