সর্বজয় তাহাতে খুব খুশি।
সকলের তাগিদে শীঘ্রই অপু পূজার কাজ আরম্ভ কুরিল-দুটি একটি করিয়া কাজকর্ম আরম্ভ হইতে হইতে ক্ৰমে এপাড়ায় ওপাড়ায় অনেক বাড়ি হইতেই লক্ষ্মীপূজায় মাকালীপূজায় তাহার ডাক আসে। অপু মহা উৎসাহে প্ৰাতঃস্নান করিয়া উপনয়নের চেলির কাপড় পরিয়া নিজের টিনের বাক্সের বাংলা নিত্যকর্মপদ্ধতিখানা হাতে লইয়া পূজা করিতে যায়। পূজা করিতে বসিয়া আনাড়ির মতো কোন অনুষ্ঠান করিতে কোন অনুষ্ঠান করে। পূজার কোন পদ্ধতি জানে না-বার বার বইয়ের উপর বুকিয়া পড়িয়া দেখে কি লেখা আছে-“বজায় তুং বলিবার পর শিবের মাথায় বঞ্জের কি গতি করিতে হইবে—‘ওঁ ব্ৰহ্মপৃষ্ঠ ঋষি সূতলছন্দঃ কূর্মো দেবতা’ বলিয়া কোন মুদ্রায় আসনের কোণ কি ভাবে ধরিতে হইবে।-কোনরকমে গোজামিল দিয়া কোজ সারিবার মতো পটুত্বও তাহার আয়ত্ত হয়। নাই, সুতরাং পদে পদে আনাড়িপনা টুকু ধরা পড়ে।
একদিন সেটুকু বেশি করিয়া ধরা পড়িল ওপাড়ার সরকারদের বাড়ি। যে ব্ৰাহ্মণ তাহাদের বাড়িতে পূজা করিত, সে কি জন্য রাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে, গৃহদেবতা নারায়ণের পূজার জন্য তাহাদের লোক অপুকে ডাকিয়া লইয়া গেল। বাড়ির বড়ো মেয়ে নিরুপমা পূজার জোগাড় করিয়া দিতেছিল, চৌদ্দ বৎসরের ছেলেকে চেলি পরিয়া পুঁথি বগলে গভীর মুখে আসিতে দেখিয়া সে একটু অবাক হইল। জিজ্ঞাসা করিল, তুমি পুজো করতে পারবে? কি নাম তোমার? চাকতি মশায় তোমার কে হন?
মুখচোরা অপুর মুখে বেশি কথা জোগাইল না, লাজুক মুখে সে গিয়া আনাড়ির মতো আসনের উপর বসিল।
পূজা কিছুদূর অগ্রসর হইতে না হইতে নিরুপমার কাছে পূজারির বিদ্যা ধরা পড়িয়া গেল। নিরুপমা হাসিয়া বলিল, ওকি? ঠাকুর নামিয়ে আগে নাইয়ে নাও, তবে তো তুলসী দেবে?–
অপু থতমত খাইয়া ঠাকুর নামাইতে গেল।
নিরুপমা বসিয়া পড়িয়া বলিল-উঁহু, তাড়াতাড়ি কোরো না। এই টাটে আগে ঠাকুর নামাও-আচ্ছা, এখন বড়ো তাম্রকুণ্ডুতে জল ঢালো–
অপু ঝুঁকিয়া পড়িয়া বইয়ের পাতা উলটাইয়া স্নানের মন্ত্র খুঁজতে লাগিল। তুলসীপত্র পরাইয়া শালগ্রামকে সিংহাসনে উঠাইতে যাইতেছে, নিরুপমা বলিল, ওকি? তুলসীপাত উপুড় করে পরাতে হয় বুঝি? চিৎ করে পরাও–
ঘামে রাঙামুখ হইয়া কোনরকমে পূজা সাঙ্গ করিয়া অপু চলিয়া আসিতেছিল, নিরুপমা ও বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা তাহাকে আসন পাতিয়া বসাইয়া ভোগের ফলমূল ও সন্দেশ জলযোগ করাইয়া। তবে ছাড়িয়া দিল।
মাসখানেক কাটিয়া গেল।
অপুর কেমন মনে হয় নিশ্চিন্দিপুরের সে অপূর্ব মায়ারূপ এখানকার কিছুতেই নাই। এই গ্রামে নদী নাই, মাঠ থাকিলেও সে মাঠ নাই, লোকজন বেশি, গ্রামের মধ্যেও লোকজন বেশি। নিশ্চিন্দিপুরের সেই উদার স্বপ্নমাখানো মাঠ, সে নদীতীর এখানে নাই, তাদের দেশের মতো গাছপালা, কত ফুলফল, পাখি, নিশ্চিন্দিপুরের সে অপূর্ব বন-বৈচিত্র্য, কোথায় সে সব? কোথায় সে নিবিড় পুম্পিত ছাতিম বন, ডালে ডালে সোনার সিঁদুর ছড়ানো সন্ধ্যা?
সরকার-বাড়ি হইতে আজকাল প্রায়ই পূজা করিবার ডাক আসে। শান্তস্বভাব, সুন্দর ও চেহারার গুণে অপুকেই আগে চায়। বিশেষ বারব্রতের দিনে পূজাপত্র সারিয়া অনেক বেলায় সে ধামা করিয়া নানাবাড়ির পূজার নৈবেদ্য ও চাল-কলা বহিয়া বাড়ি আনে। সর্বজয়া হাসিমুখে বলে, ওঃ, আজ চাল তো অনেক হয়েচে!–দেখি! সন্দেশ কদের বাড়ির নৈবিদ্যিতে দিল রে!
অপু খুশির সহিত দেখাইয়া বলে, কুণ্ডুবাড়ি থেকে কেমন একছড়া কলা দিয়েচে, দেখেচো মা?
সর্বজয়া বলে, এবার বোধহয় ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন, এদের ধরে থাকা যাক, গিন্নি লোক বড়ো ভালো। মেজছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে তত্ত্ব পাঠিয়েচে-অসময়ের আম-অমনি আমার এখানে পাঠিয়ে দিয়েচে-খাস এখন দুধ দিয়ে।
এত নানারকমের ভালো জিনিস সর্বজয়া কখনও নিজের আয়ত্তের মধ্যে পায় নাই। তাহার কতকালের স্বপ্ন! নিশ্চিন্দিপুরের বাড়িতে কত নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে, উঠানের উপর ঝুঁকিয়া-পড়া বাঁশবনের পত্ৰস্পন্দনে, ঘুঘুর ডাকে, তাহার অবসন্ন অন্যমনস্ক মন যে অবাস্তব সচ্ছলতার ছবি আপন মনে ভাঙ্গিত গড়িত-হাতে খরচ নাই, ফুটা বাড়িতে জল পড়ে বৃষ্টির রাত্রে, পাড়ায় মুখ পায় না, সকলে তুচ্ছ করে, তাচ্ছিল্য করে, মানুষ বলিয়াই গণ্য করে না-সে সব দিনের স্মৃতির সঙ্গে, আমবুল শাকের বনে পুরানো পাচিলের দীর্ঘছায়ার সঙ্গে যে সব দূরকালের দুরাশার রঙে রঙিন ভবিষ্যৎ জড়ানো ছিল–এই তো এতদিনে তাহারা পৃথিবীর মাটিতে নামিয়া আসিয়াছে।
পূজার কাজে অপুর অত্যন্ত উৎসাহী। রোজ সকালে উঠিয়া সে কলুপাড়ার একটা গাছ হইতে রাশীকৃত কচি কচি বেলপাতা পাড়িয়া আনে। একটা খাতা বাঁধিয়াছে, তাহাতে সর্বদা ব্যবহারের সুবিধার জন্য নানা দেব-দেবীর স্তবের মন্ত্র, মানের মন্ত্র, তুলসীদান প্ৰণালী লিখিয়া লইয়াছে। পাড়ায় পূজা করিতে নিজের তোলা ফুল-বেলপাতা লইয়া যায়, পূজার সকল পদ্ধতি নিখুঁতভাবে জানা না থাকিলেও উৎসাহ ও একাগ্রতায় সে সকল অভাব পূরণ করিয়া লয়।
বর্ষাকালের মাঝামাঝি অপু একদিন মাকে বলিল যে, সে স্কুলে পড়িতে যাইবে। সর্বজয়া আশ্চর্য হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কোন ইস্কুল রে?
–কেন, এই তো আড়াবোয়ালেতে বেশ ইস্কুল রয়েচে।
–সে তো এখেন থেকে যেতে-আসতে চার ক্রোশ পথ। সেখেনে যাবি হেঁটে পড়তে?
সর্বজয়া কথাটা তখনকার মতো উড়াইয়া দিল বটে, কিন্তু ছেলের মুখে কয়েকদিন ধরিয়া বার বার কথাটা শুনিয়া সে শেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, যা খুশি করো অপু, আমি জানি নে। তোমরা কোনো কালে কাবুর কথা তো শুনলে না? শুনবেও না-সেই একজন নিজের খেয়ালে সারাজন্ম কাটিয়ে গেল, তোমারও তো সে ধারা বজায় রাখা চাই! ইস্কুলে পড়বো! ইস্কুলে পড়বি তো এদিকে কি হবে? দিব্যি একটা যাহোক দাঁড়াবার পথ তুবু হয়ে আসছে—এখন তুমি দাও ছেড়ে–তারপর ইদিকেও যাক, ওদিকেও যাক