চক্ৰবর্তী মহাশয় আসিবার সময় যে তেলিবাড়ির উল্লেখ করিয়াছিলেন, বৈকালের দিকে তাহাদের বাড়ির সকলে দেখিতে আসিল। তেলি-গিন্নি খুব মোটা, রং বেজায় কালো। সঙ্গে চারপাঁচটি ছেলেমেয়ে, দুটি পুত্রবধু। প্রায় সকলেরই হাতে মোটা মোটা সোনার অনন্ত দেখিয়া সর্বজয়ার মন সম্রামে পূর্ণ হইয়া উঠিল। ঘরের ভিতর হইতে দু-খানা কুশাসন বাহির করিয়া আনিয়া সলজ্জা ভাবে বলিল, আসুন আসুন, বসুন।
তেলি-গিন্নি পায়েরু ধূলা লইয়া প্ৰণাম করিলে ছেলেমেয়ে ও পুত্রবধুরাও দেখাদেখি তাহাই করিল। তেলি-গিন্নি হাসিমুখে বলিল, দুপুরবেলা এলেন মা-ঠাকরুন। একবার বলি যাই। এই যে পাশেই বাড়ি, তা আসতে পেলাম না। মেজছেলে এলো গোয়াড়ী থেকে-গোয়াড়ীতে দোকান আছে কি-না! মেজ বৌমার মেয়েটাও ন্যাওটো, মা দেখতে ফুরসত পায় না, দুপুরবেলা আমাকে একেবারে পেয়ে বসে-ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বেলা দুটো! ঘুঙড়ি কাশি, গুপী কবরেজ বলেছে ময়ূরপুচ্ছ পুড়িয়ে মধু দিয়ে খাওয়াতে। তাই কি সোজাসুজি পুড়ুলে হবে মা, চৌষট্টি ফৈজৎ—কাসার ঘটির মধ্যে পোরো, তা ঘুটের জ্বাল করো, তা টিমে আঁচে চড়াও। হ্যারে হাজরী, ভোঁদা গোয়াড়ী থেকে কাল মধু এনেছে কি-না জানিস?
আঠারো-উনিশ বছরের একটি মেয়ে ঘাড় নাড়িয়া কথাব উত্তর দিবার পূর্বেই তেলি-গিন্নি তাহাকে দেখাইয়া বলিল, ওইটি আমার মেজ মেয়ে-বহরমপুরে বিয়ে দিয়েচি। জামাই বড়োবাজারে এদের দোকানে কাজকর্ম করেন। নিজেদেরও গোলা, দোকান রয়োচে কালনা-বেয়াই সেখানে দেখেন শোনেন। কিন্তু হলে হবে কি মা—এমন কথা ভূভারতে কেউ কখনও শোনে নি। দুই ছেলে, নাতি নাতনী, বেয়ান মারা গেলেন ভাদর মাসে, মাঘ মাসে বুড়ো আবার বিয়ে করে আনলে। এখন ছেলেদের সব দিয়েছে ভেন্ন করে। জামাইয়ের মুশকিল, ছেলেমানুষ-তা। উনি বলেছেন, তা এখন তুমি বাবা আমাদের দোকানেই থাকো, কাজ দেখো শোনো শেখো, ব্যবসাদারের ছেলে, তারপর একটা হিল্পে লাগিয়ে দেওয়া যাবে।
বড়ো পুত্রবধূ এতক্ষণ কথা বলে নাই। সেইহাদের মতো জুড়ু বানিস নয়, বেশ টকটকে রং। বোধ হয় শহর-অঞ্চলের মেয়ে। এ-দলের মধ্যে সেই সুন্দরী, বয়স বাইশ-তেইশ হইবে। সে নিচের ঠোঁটের কেমন চমৎকার এক প্রকার ভঙ্গি করিয়া বলিল, এরা এসেছেন, সারাদিন খাওয়া-দাওয়া হয় নি, এঁদের আজকের সব ব্যবস্থা তো করে দিতে হবে? বেলাও তো গিয়েছে, এঁরা আবার রান্না করবেন!
এই সময় অপু বাড়ির উঠানে ঢুকিল। সে আসিয়াই গ্রামখানা বেড়াইয়া দেখিতে বাহিরে গিয়াছিল। তেলি-গিন্নি বলিল-কে মা-ঠাকরুন? ছেলে বুঝি? এই এক ছেলে? বাঃ, চেহারা যেন রাজপুত্ত্বর।
সকলেরই চোখ তাহার উপর পড়িল। অপু উঠানে ঢুকিয়াই এতগুলি অপরিচিতের সম্মুখে পড়িয়া কিছু লজ্জিত ও সংকুচিত হইয়া উঠিল। পাশ কাটাইয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিতেছিল, তাহার মা বলিল, দাঁড়া না। এখেনে। ভারি লাজুক ছেলে মা-এখন ওইটুকুতে দাঁড়িয়েচে-আর এক মেয়ে ছিল, তা-সর্বজয়ার গলার স্বর ভারী হইয়া আসিল। গিন্নি ও বড়ো পুত্রবধূ একসঙ্গে বলিল, নেই, হ্যাঁ মা? সর্বজয়া বলিল, সে কি মেয়ে মা! আমায় ছলতে এসেছিল, কি চুল, কি চোখ, কি মিষ্টি কথা? বকো-ঝাঁকো, গাল দাও, মা’র মুখে উঁচু কথাটি কেউ শোনে নি কোনদিন।
ছোট বউ বলিল, কত বয়সে গেল মা?
–এই তেরোয় পড়েই-ভাদ্র মাসে তেরোয় পড়ল, আশ্বিন মাসের ৭ই-দেখতে দেখতে চার বছর হয়ে গেল।
তেলি-গিন্নি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া কহিল-আহা মা, তা কি করবে বলো, সংসারে থাকতে গেলে সবই…তাই উনি বললেন-আমি বললাম। আসুন তারা-চাকতি মশায় পূজা-আচ্চা করেনতা উনি মেয়েজামাই মারা যাওয়ার পর থেকে বড়ো থাকেন না। গায়ে একঘর বামুন নেই।– কাজকর্মে সেই গোয়াড়ী দৌড়তে হয়-থাকলে ভালো! বীরভূম না বাঁকড়ো জেলা থেকে সেবার এলো কি চাটুজ্যে। কি নামটা রে পাঁচী? বললে বাস করবো। বাড়ি থেকে চালডাল সিধে পাঠিয়ে দিই। তিন মাস রইল, বলে আজ ছেলেপিলে আনব্য-কাল ছেলেপিলে আনব-ও মা, এক মাগী গোয়ালার মেয়ে উঠোন ঝাঁট দিত। আমাদের, তা বলি বামুন মানুষ এসেছে, ওঁরাও কাজটা করে দিস।। ঘেন্নার কথা শোনো মা, আবা বছর শিবরাত্রির দিন-তাকে নিয়ে—
বউ-দুটি ও মেয়েরা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
সর্বজয়া অবাক হইয়া বলিল, পালালো নাকি?
–পালালো কি এমন তেমন পালালো মা? সেই সঙ্গে আমাদের এক প্রস্থ বাসন। কিছুই জানি নে মা, সব নিজের ঘর থেকে.বলি আহা বামুন এসেচে-সবুক, আছে বাড়তি। তা সেই বাসন সবসুদ্ধ নিয়ে দুজনে নিউদ্দিশ! যাক সে সব কথা মা, উঠি তাহলে আজ। রান্নার কি আছে না-আছে বলে মা, সব দিই বন্দোবস্ত করে।
আট-দশ দিন কাটিয়া গেল; সর্বজয়া ঘরবাড়ি মনের মতো করিয়া সাজাইয়াছে। দেওয়াল উঠান নিকাইয়া পুঁছিয়া লইয়াছে। নিজস্ব ঘরদের অনেকদিন ছিল না, নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া অবধিই নাই-এতদিন পরে একটা সংসারের সমস্ত ভার হাতে পাইয়া সে গত চার বৎসরের সঞ্চিত সাধ মিটাইতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল।
জ্যাঠামশায় লোক মন্দ নহেন বটে, কিন্তু শীঘ্রই সর্বজয়া দেখিল তিনি একটু বেশি কৃপণ। ক্ৰমে ইহাও বোঝা গেল—তিনি যে নিছক পরার্থপরতার ঝোঁকেই ইহাদের এখানে আনিয়াছেন অহা নহে, অনেকটা আনিয়াছেন নিজের গরজে। তেলিদের প্রতিষ্ঠিত ঠাকুরটি পূজা না করিলে সংসায় ভালো রূপ চলে না, তাহাদের বার্ষিক বৃত্তিও বন্ধ হইয়া যায়। এই বার্ষিক বৃত্তি সম্বল করিয়াই তিনি কাশী থাকেন। পাকা লোক, অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া তবে তিনি ইহাদের আনিয়া তুলিয়াছেন। সর্বজয়াকে প্রায়ই বলেন–জয়া, তোর ছেলেকে বল কাজকর্ম সব দেখে নিতে। আমার মেয়াদ আর কতদিন? ওদের বাড়ির কাজটা দিক না আরম্ভ করে-সিধের চালেই তো মাস চলে যাবে।