–কি রকম গাড়ি? তারের ওপর দিয়ে চলে?
–একটা ডাণ্ডা আছে। তারে ঠেকে থাকে, তাতেই চলে। কলকাতা গেলে দেখবে এখনছ-সাত বছর হল ইলেকট্রিক ট্রাম হয়েছে, আগে ঘোড়ায় টানতো–
আরও অনেকক্ষণ দু-জনের কথাবার্তা চলিল।
বৈকালে সর্বজয়ার জ্যাঠামশায় ভবতারণ চক্ৰবর্তী আসিলেন। অপুকে কাছে ডাকিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। ঠিক করিলেন, দুইদিন পরে বুধবারের দিন লইয়া যাইবেন। অপু দু-একবার ভাবিল লীলার প্রস্তাবটা একবার মায়ের কাছে তোলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কথাটা আর কার্যে পরিণত হইল না।
সকালের রৌদ্র ফুটিয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গেই উলা স্টেশনে গাড়ি আসিয়া দাঁড়াইল। এখান হইতেই মনসাপোত যাইবার সুবিধা। ভবতারণ চক্ৰবর্তী পূর্ব হইতেই পত্ৰ দিয়া গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছিলেন। কাল রাত্রে একটু কষ্ট হইয়াছিল। এক্সপ্রেস ট্রেনখানা দেরিতে পৌঁছানোর জন্য ব্যান্ডেল হইতে নৈহাটির গাড়িখানা পাওয়া যায় নাই। ফলে বেশি রাত্রে নৈহাটিতে আসিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিতে হইয়াছিল।
সারারাত্রি জাগরণের ফলে অপু কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল সে জানে না। চক্ৰবর্তী মহাশয়ের ডাকে উঠিয়া জানোলা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিল একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গাড়ি লাগিয়াছে। সেখানেই তাদের নামিতে হইবে। কুলিরা ইতিমধ্যে তাহাদের কিছু জিনিসপত্র নামাইয়াছে।
গোবুর গাড়িতে উঠিয়া চক্ৰবর্তী মহাশয় অনবরত তামাক টানিতে লাগিলেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হইবে, একহারা পাতলা চেহারা, মুখে দাড়ি গোফ নাই, মাথার চুল সব পাকা। বলিলেনজয়া, ঘুম পাচ্ছে না তো?
সর্বজয়া হাসিয়া বলিল, আমি তো নৈহাটিতে ঘুমিয়ে নিইচি আধঘণ্টা, অপুও ঘুমিয়েচে। আপনারই ঘুম হয় নি
চক্ৰবর্তী মহাশয় খুব খানিকটা কাশিয়া লইয়া বলিলেন,-ওঃ, সোজা খোজটা করেছি। তোদের! আর-বছর বোশেখে মেয়েটা গেল মারা, হরিধান তো তার আগেই। এই বয়সে হাত পুড়িয়ে রোধেও খেতে হয়েছে,-কেউ নেই সংসারে। তাই ভাবলাম হরিহর বাবাজীর তো নিশ্চিন্দিপুর থেকে উঠে যাবার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন থেকেই, যাই এখানেই নিয়ে আসি। একটু ধানের জমি আছে, গৃহদেবতার সেবাটাও হবে। গ্রামে ব্রাহ্মণ তেমন নেই,–আর আমি তো এখানে থাকব না। আমি একটু কিছু ঠিক করে দিয়েই কাশী চলে যাবো। একরকম করে হরিহর নেবেন চালিয়ে। তাই গেলাম নিশ্চিন্দিপুর–
সর্বজয়া বলিল, আপনি বুঝি আমাদের কাশী যাওয়ার কথা শোনেননি?
—তা কি করে শুনবো? তোমাদের দেশে গিয়ে শুনলাম তোমরা নেই। সেখানে। কেউ তোমাদের কথা বলতে পারে না-সবাই বলে তারা এখান থেকে বেচে-কিনে তিন-চার বছর হল কাশী চলে গিয়েছে। তখন কাশী যাই। কাশী আমি আছি আজ দশ বছর। খুঁজতেই সব বেরিয়ে পড়লো। হিসেব করে দেখলাম হরিহর যখন মারা যান, তখন আমিও কাশীতেই আছি, অথচ কখনও দেখাশুনো হয় নি, তা হলে কি আর–
অপু আগ্রহের সুরে বলিল, নিশ্চিন্দিপুরে আমাদের বাড়িটা কেমন আচে, দাদামশায়?
–সেদিকে আমি গোলাম কাই! পথেই সব খবর পেলাম কি-না। আমি আর সেখানে দাঁড়াই নি। কেউ ঠিকানা দিতে পারলে না। ভুবন মুখুজ্যে মশায় অবিশ্যি খাওয়া-দাওয়া করতে বললেন, আর তোমার বাপের একশো নিন্দে-বুদ্ধি নেই, সাংসারিক জ্ঞান নেই।–হেন তেন। যাক সেসব কথা, তোমরা এলে ভালো হল। যে ক’ঘর যজমান আছে তোমাদের বছর তাতে কেটে যাবে। পাশেই তেলিরা বেশ অবস্থাপন্ন, তাদের ঠাকুর প্রতিষ্ঠা আছে। আমি পুজোটুজো করতাম অবিশ্যি, সেটাও হাতে নিতে হবে ক্ৰমে। তোমাদের নিজেদের জিনিস দেখে শূনে নিতে হবে–
উলা গ্রামের মধ্যেও খুব বন, গ্রাম ছাড়াইয়া মাঠের পথেও বনঝোপ। সূৰ্য আকাশে অনেকখানি উঠিয়া গিয়াছে, চারিধারে প্রভাতী রৌদ্রের মেলা। পথের ধারে বনতুলসীর জঙ্গল, মাঠের ঘাসে এখনও স্থানে স্থানে শিশির জমিয়া আছে, কোন বুপকথার দেশের মাকড়সা যেন বুপলি জাল বুনিয়া রাখিয়াছে। মাঝে মাঝে কিসের একটা গন্ধ, বিশেষ কোনও ফুল ফলের গন্ধ নয়। কিন্তু। শিশিরসিক্ত ঘাস, সকালের বাতাস, অড়হরের ক্ষেত, এখানে ওখানে বনজ গাছপালা, সবসুদ্ধ মিলাইয়া একটা সুন্দর সুগন্ধ।
অনেকদিন পরে এই সব গাছপালার প্রথম দৰ্শন অপুর প্রাণে একটা উল্লাসের ঢেউ উঠিল। অপূর্ব অদ্ভুত, সুতীব্র; মিনমিনে ধরনের নয়, পানসে গানসে জোলো ধরনের নয়। অপুর মন সে শ্রেণীরই নয় আদৌ, তাহা সেই শ্রেণীর যাহা জীবনের সকল অবদানকে, ঐশ্বর্যকে প্ৰাণপণে নিংড়াইয়া চুযিয়া আঁটিসার করিয়া খাইবার ক্ষমতা রাখে। অল্পেই নাচিয়া ওঠে, অল্পে দমিয়াও যায়—যদিও পুনরায় নাচিয়া উঠিতে বেশি বিলম্ব করে না।
মনসাপোতা গ্রামে যখন গাড়ি ঢুকিল তখন বেলা দুপুর। সর্বজয়া ছাইয়ের পিছন দিকের ফাঁক দিয়া চাহিয়া দেখিতেছে তাহার নূতনতম জীবনযাত্রা আরম্ভ করিবার স্থানটা কি রকম। তাহার মনে হইল গ্রামটাতে লোকের বাস একটু বেশি, একটু যেন বেশি ঠেসাঠেসি, ফাকা জায়গা বেশি নাই, গ্রামের মধ্যে বেশি বনজঙ্গলের বালাইও নাই। একটা কাহাদের বাড়ি, বাহির-বাটীর দাওয়ায় জনকয়েক লোক গল্প করিতেছিল, গোরুর গাড়িতে কাহারা আসিতেছে দেখিয়া চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল। উঠানে বাঁশের আলনায় মাছ ধরিবার জাল শুকাইতে দিয়াছে। বোধ হয়। গ্রামের জেলেপাড়া।
আরও খানিক গিয়া গাড়ি দাঁড়াইল। ছোট্ট উঠানের সামনে একখানি মাঝারি গোছের চালাঘর, দু-খানা ছোট্ট দোচালা ঘর, উঠানে একটা পেয়ারা গাছ ও একপাশে একটা পাতকুয়া। বাড়ির পিছনে একটা তেঁতুল গাছ–তাহার ডালপালা বড়ো চালাঘরখানার উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। সামনের উঠানটা বাঁশের জাফরি দিয়া ঘেরা। চক্ৰবর্তী মহাশয় গাড়ি হইতে নামিলেন। অপু মা’কে হাত ধরিয়া নামাইল।