অপু বলিল, তুমি কি করে এলে? আমি আজ সকালেও জিজ্ঞেস করিচি। নিস্তারিণী মাসি বললে, তুমি আসবে না, এখন স্কুলের ছুটি নেই-সেই বড়োদিনের সময় নাকি আসবে?
লীলা বলিল, আমার কথা তোমার মনে ছিল?
–না, তা কেন? তারপর এতদিন পরে বুঝি-বেশ-একেবারে ড়ুমুরের ফুল-
–ড়ুমুরের ফুল আমি, না তুমি? খোকামণির ভাতের সময় তোমাকে যাওয়ার জন্যে চিঠি লেখোলাম ঠাকুরমায়ের কাছে, এ বাড়ির সবাই গেল, যাও নি কেন?
অপু এসব কথা কিছুই জানে না। তাহাকে কেহ বলে নাই। জিজ্ঞাসা করিল, খোকামণি কে?
লীলা বলিল, বাঃ, আমার ভাই! জানো না?…এই এক বছরের হলো।
লীলার জন্য অপুর মনে একটু দুঃখ হইল। লীলা জানে না। যাহাকে সে এত আগ্ৰহ করিয়া ভাইয়ের অন্নপ্রাশনে নিমন্ত্রণ করিয়াছিল, এ বাড়িতে তাহার স্থান কোথায় বা অবস্থা কি। সে বলিলদেড় বছর আসো নি-না? পড়চ কোন ক্লাসে?
লীলা তক্তপোশের কোণে বসিয়া পড়িল। বলিল, আমি আমার কথা কিছু বলবো না আগে– আগে তোমার কথা বলো। তোমার মা ভালো আছেন? তুমিও তো পড়ো-না?
-আমি এবারে মাইনর ক্লাসে উঠবো-পরে একটু গর্বিতমুখে বলিল, আর বছর ফাস্ট হয়ে ক্লাসে উঠেচি, প্রাইজ দিয়েচে।
লীলা অপুর দিকে চাহিল। বেলা তিনটার কম নয়। এত বেলায় সে খাইতে বসিয়াছে! বিস্ময়ের সুরে বলিল, এখন খেতে বসেচ, এত বেলায়?
অপুর লজ্জা হইল। সে সকালে সরকারদের ঘরে বসিয়া খাইয়া স্কুলে যায়—শুধু ডালভাত-তাও শ্ৰীকণ্ঠ ঠাকুর বেগার-শোধ ভাবে দিয়া যায়, খাইয়া পেট ভরে না, স্কুলেই ক্ষুধা পায়, সেখান হইতে ফিরিয়া মায়ের পাতে ভাত ঢাকা থাকে, বৈকালে তাঁহাই খায়। আজ ছুটির দিন বলিয়া সকালেই মায়ের পাতে খাইতে বসিয়াছে।
অপু ভালো করিয়া উত্তর দিতে পারিল না বটে, কিন্তু লীলা ব্যাপারটা কতক না বুঝিল এমন নহে। ঘরের হীন আসবাব-পত্র, অপুর হীন বেশ-অবেলায় নিরুপকরণ দুটি ভাত সাগ্রহে খাওয়া– লীলার কেন যেন মনে বড়ো বিঁধিল। সে কোন কথা বলিল না।
অপু বলিল, তোমার সব বই এনেচ। এখেনে? দেখাতে হবে আমাকে। ভালো গল্প কি ছবির বই নেই?
লীলা বলিল, তোমার জন্যে কিনে এনেচি আসিবার সময়। তুমি গল্পের বই ভালোবাসো বলে একখানা সাগরের কথা’ এনেচি, আরও দু-তিনখানা এনেচি, আনচি, তুমি খেয়ে ওঠে।
অপুর খাওয়া প্রায় শেষ হইয়াছিল, খুশিতে বাকিটা কোনোরকমে শেষ করিয়া উঠিয়া পড়িল। লীলা লক্ষ করিয়া দেখিল, সে পাতের সবটা এমন করিয়া খাইয়াছে, পাতে একটা দানাও পড়িয়া নাই। সঙ্গে সঙ্গে তাহার উপর লীলার কেমন একটা অপুর্ব মনের ভাব হইল-সে ধরনের অনুভূতি লীলার জীবনে এই প্রথম, আর কাহারও সম্পর্কে সে ধরনের কিছু তো কখনও হয়। নাই।
একটু পরে লীলা অনেক বই আনিল। অপুর মনে হইল, লীলা কেমন করিয়া তাহার মনের কথাটি জানিয়া, সে যাহা পড়িতে জানিতে ভালোবাসে সেই ধরনের বইগুলি আনিয়াছে। সাগরের কথা’ বইখানাতে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প। সাগরের তলায় বড়ো বড়ো পাহাড় আছে, আগ্নেয়গিরি আছে, প্রবাল নামক এক প্রকার প্রাণী আছে, দেখিতে গাছপালার মতো-কোথায় এক মহাদেশ নাকি সমুদ্রের গর্ভে ড়ুবিয়া আছে-এই সব।
লীলা একখানা পুরাতন খাতা দেখাইল। তাহার ঝোঁক ছবি আঁকিবার দিকে; বলিল-সেই তোমায় একবার ফুলগাছ একে দেখতে দিলাম মনে আছে? তারপর কত একেচি দেখবে?
অপুর মনে হইল লীলার হাতের আঁকা আগের চেয়ে এখন ভালো হইয়াছে। সে নিজে একটা রেখা কখনও সোজা করিয়া টানিতে পারে না-ড্রইংগুলি দেখিতে দেখিতে লীলার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বেশ এঁকেচো তো। তোমাদের ইস্কুলে করায়, না এমনি আঁকো?
এতক্ষণ পরে অপুর মনে পড়িল লীলা কোন স্কুলে পড়ে, কোন ক্লাসে পড়ে সে কথা কিছুই জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। বলিল-তোমাদের কি ইস্কুল? এবার কোন ক্লাসে পড়চো?
-এবার মাইনর সেকেন্ড ক্লাসে উঠেছি-গিরীন্দ্রমোহিনী গার্লস স্কুল—আমাদের বাড়ির পাশেই–
অপু বলিল, জিজ্ঞেস করবো?
লীলা হাসি মুখে ঘাড় নাড়িয়া চুপ করিয়া রহিল।
অপু বলিল, আচ্ছা বলো-চট্টগ্রাম কর্ণফুলির মোহনায়-কি ইংরেজি হবে?
লীলা ভাবিয়া বলিল, চিটাগং ইজ অন দি মাউথ অফ দি কর্ণফুলি।
অপু বলিল, ক’জন মাস্টার তোমাদের সেখেনে?
-আটজন, হেড মিস্ট্রেস এন্ট্রান্স পাশ, আমাদের গ্রামার পড়ান। পরে সে বলিল-মা’র সঙ্গে দেখা করবে না?
-এখন যাবো, না একটু পরে যাবো? বিকেলে যাবো এখন, সেই ভালো।
তাহার পরে সে একটু থামিয়া বলিল, তুমি শোনো নি লীলা, আমরা যে এখান থেকে চলে যাচি!
লীলা আশ্চর্য হইয়া অপুর দিকে চাহিল। বলিল-কোথায়?
–আমার এক দাদামশায় আছেন, তিনি এতদিন পরে আমাদের খোঁজ পেয়ে তাদের দেশের বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন।
অপু সংক্ষেপে সব বলিল।
লীলা বলিয়া উঠিল-চলে যাবে? বাঃ রে!
হয়তো সে কি আপত্তি করিতে যাইতেছিল, কিন্তু পরীক্ষণেই বুঝিল, যাওয়া না-যাওয়ার উপর অপুর তো কোনও হাত নাই, কোনও কথাই এক্ষেত্রে বলা চলিতে পারে না।
খানিকক্ষণ কেহই কথা বলিল না।
লীলা বলিল, তুমি বেশ এখানে থেকে ইস্কুলে পড়ো না কেন? সেখানে কি ইস্কুল আছে? পড়বে কোথায়? সে তো পাড়াগা।
—আমি থাকতে পারি। কিন্তু মা তো আমায়। এখেনে রেখে থাকতে পারবে না, নইলে আর কি–
–না হয় এক কাজ করো না কেন? কলকাতায় আমাদের বাড়ি থেকে পড়বে। আমি মাকে বলবো, অপূর্ব আমাদের বাড়িতে থাকবে; বেশ সুবিধে—আমাদের বাড়ির সামনে আজকাল ইলেকট্রিক ট্রাম হয়েছে—এঞ্জিনও নেই, ঘোড়াও নেই, এমনি চলে-তারের মধ্যে বিদ্যুৎ পোরা আছে, তাতে চলে।