অপু বলিল, বেশ হয়, না মা? এদের এখেনে একদণ্ড ভালো লাগে না। তোমার খাটুনিটা কমে-সেই সকালে উঠে রান্না-বাড়ি ঢোকো, আর দুটো তিনটে–
ব্যাপারটা এখনও সর্বজয়া বিশ্বাস করে নাই। আবার গৃহ মিলিবে, আশ্রয় মিলিবে, নিজের মনোমতো ঘর গড়া চলিবে! বড়োলোকের বাড়ির এ রাঁধুনীবৃত্তি, এ ছন্নছাড়া জীবনযাত্রায় কি এতদিনে-বিশ্বাস হয় না। অদৃষ্ট তেমন নয় বলিয়া ভয় কবে।
তাহার পর দু-জনে মিলিয়া নানা কথাবার্তা চলিল। জ্যাঠামশায় কি রকম লোক, সেখানে যাওয়া ঘটিলে কেমন হয়,–নানা কথা, উঠিবার সময় অপু বলিল-শেঠেদের বাড়িব পাশে কাঠগোলায় পুতুলনাচ হবে একটু পরে। দেখে আসবো মা?
–সকাল সকাল ফিরবি, যেন ফটক বন্ধ করে দেয় না, দেখিস—
পথে যাইতে যাইতে খুশিতে তাহার গা কেমন করিতে লাগিল। মন যেন শোলার মতো হালকা। মুক্তি, এতদিন পরে মুক্তি! কিন্তু লীলা যে আসিতেছে? পুতুলনাচের আসরে বসিয়া কেবলই লীলার কথা মনে হইতে লাগিল। লীলা আসিয়া তাহার সহিত মিশিবে তো? হয়তো এখন বড়ো হইয়াছে, হয়তো আর তাহার সঙ্গে কথা বলিবে না।
পুতুলনাচ আরম্ভ হইতে অনেক দেরি হইয়া গেল। না দেখিয়াও সে যাইতে পারিল না। অনেক রাত্রে যখন আসর ভাঙিয়া গেল, তখন তাহার মনে পড়িল, এত রাত্রে বাড়ি ঢোকা যাইবে না, ফটক বন্ধ করিয়া দিয়াছে, বড়োলোকের বাড়ির দারোয়ানেরা কেহ তাহার জন্য গরজ করিয়া ফটক খুলিয়া দিবে না। সঙ্গে সঙ্গে বড়ো ভয়ও হইল। রাত্ৰিতে এ রকম একা সে বাড়ির বাহিরে কাটায় নাই। কোথায় এখন সে থাকে? মা-ই বা কি বলিবে!
আসরের সব লোক চলিয়া গেল। আসরের কোণে একটা পান-লেমনেডের দোকানো তখনও বেচা-কেনা চলিতেছে। সেখানে একটা কাঠের বাক্সের উপর সে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তারপর কখন সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে জানে না, ঘুম ভাঙিয়া দেখিল ভোর হইয়া গিয়াছে, পথে লোক চলাচল আরম্ভ হইয়াছে।
সে একটু বেলা করিয়া বাড়ি ফিরিল। ফটকের কাছে বাড়ির গাড়ি দুইখানি তৈয়ার হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। দেউড়িতে ঢুকিয়া খানিকটা আসিয়া দেখিল বাড়ির তিন-চার জন ছেলে সাজিয়া গুজিয়া কোথায় চলিয়াছে। নিজেদের ঘরের সামনে নিস্তারিণী বিকে পাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, মাসিম, এত সকালে গাড়ি যাচ্ছে কোথায়? মেজবাবুরা কি আজকে আসবে?
নিস্তারিণী বলিল, তাই তো পুনছি। কাল চিঠি এসেচে-শুধু মেজবাবু আর বৌরানী আসবে, লীলা দিদিমণি এখন আসবেন না-ইস্কুলের এগজামিন। সেই বড়োদিনের সময় তবে আসবে। গিন্নিমা বলছিলেন বিকেলে–
অপুর মনটা একমুহূর্তে দমিয়া গেল। লীলা আসিবে না! বড়োদিনের ছুটিতে আসিলেই বা কি-সে তো তাহার আগে এখান হইতে চলিয়া যাইবে। যাইবার আগে একবার দেখা হইয়া যাইত এই সময় আসিলে। কতদিন সে আসে নাই।
তাহার মা বলিল, বেশ ছেলে তো, কোথায় ছিলি রাত্তিরে? আমার ভেবে সারারাত চোখের পাতা বোজেনি কাল।
অপু বলিল, রাত বেশি হয়ে গেল, ফটক বন্ধ করে দেবে জানি, তাই আমার এক বন্ধু ছিল, আমার সঙ্গে পড়ে, তাদেরই বাড়িতে-। পরে হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, না মা, সেখানে পানের দোকানে একটা কেরোসিন কাঠের বাক্স পড়ে ছিল, তার উপর শুয়ে–
সর্বজয়া বলিল, ওমা, আমার কি হবে। এই সারারাত ঠাণ্ডায় সেখেনে-লক্ষ্মীছাড়া ছেলে, যেয়ো তুমি ফের কোনদিন সন্দেব পর কোথাও-তোমার বড়ো ইয়ে হয়েচে, না?
অপু হাসিয়া বলিল-তা আমি কি করে ঢুকবো বলো না? ফটিক ভেঙে ঢুকবো?
রাগটা একটু কমিয়া আসিলে সর্বজয়া বলিল-তারপর জ্যাঠামশায় তো কাল এসেচেন। তুই বেরিয়ে গেলে একটু পরেই এলেন, তোর খোঁজ করলেন, আজ ওবেলা আবার আসবেন। বললেন, এখেনে কোথায় তার জানাশশুনো লোক আছে, তাদের বাড়ি থাকবেন। এদের বাড়ি থাকবার অসুবিধে-পবণ্ড নিয়ে যেতে চাচ্চেন।
অপু বলিল, সত্যি? কি কি বলো না মা, কি সব কথা হল?
আগ্রহে অপু মায়ের পাশে চৌকির ধারে বসিয়া পড়িয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিল। দু-জনের অনেক কথাবার্তা হইল। জ্যাঠামশায় বলিয়াছেন, তাহার। আর কেহ নাই, ইহাদেবীই উপর সব ভার দিয়া তিনি কাশী যাইবেন। অনেকদিন পরে সংসার পাতিবার আশায় সর্বজয়া আনন্দে উৎফুল্প। ইহাদের বাড়ি হইতে নানা টুকটাক গৃহস্থালিব প্রযোজনীয় জিনিস নানা সময় সংগ্ৰহ করিযা সযত্নে বাখিযা দিয়াছে। একটা বড়ো টিনের টেমি দেখাইয়া বলিল, সেখেনে রান্নাঘবে জ্বালবো-কত বড়ো লম্পটা দেখেচিস? দু-পয়সোব তেল ধবে।
দুপুরের পব সে মায়ের পাতে ভাত খাইতে বসিয়াচে, এমন সময় দুয়ারের সামনে কাহার ছায়া পড়িল। চাহিয়া দেখিয়া সে ভাতের গ্রাস আর মুখে তুলিতে পারিল না।
লীলা!
পরীক্ষণেই লীলা হাসিমুখে ঘরে ঢুকিল; কিন্তু অপুর দিকে চাহিয়া সে যেন একটু অবাক হইযা গেল। অপুকে যেন আর চেনা যায় না।-সে তো দেখিতে বরাববই সুন্দব, কিন্তু এই দেড় বৎসরে কি হইয়া উঠিয়াছে সে? কি গায়ের রং, কি মুখের শ্ৰী, কি সুন্দর স্বপ্ন-মাখা চোখদুটি! লীলার যেন একটু লজ্জা হইল। বলিল, উঃ, আগের চেয়ে মাথাতে কত বড়ো হয়ে গিয়েচ!
লীলার সম্বন্ধেও অপুর ঠিক সেই কথাই মনে হইল। এ যেন সে লীলা নয়, যাহার সঙ্গে সে দেড় বৎসর পূর্বে অবাধে মিলিয়া মিশিয়া কত গল্প ও খেলা করিয়াছে। তাহার তো মনে হয় না। লীলার মতো সুন্দরী মেয়ে সে কোথাও দেখিয়াছে।–রানুদিও নয়। খানিকক্ষণ সে যেন চোখ ফিরাইতে পারিল না।
দুজনেই যেন একটু সংকোচ বোধ করিতে লাগিল।