ছেলে যে চাকুরির কথা একে ওকে জিজ্ঞাসা করিয়া বেড়ায় সর্বজয়া একথা জানে। চাকুরি হইলে সে মন্দ কথা নয়, কিন্তু অপুর মুখে চাকুরির কথা তাহার মোটেই ভালো লাগে না। সে তো এমন কিছু বড়ো হয় নাই। তাহা ছাড়া রৌদ্র আছে, বৃষ্টি আছে। শহর-বাজার জায়গা, পথে ঘাটে গাড়ি-ঘোড়া-কত বিপদ! অত বিপদের মুখে ছেলেকে ছাড়িয়া দিতে সে রাজি নয়।
সর্বজয়া কথাটা তেমন গায়ে মাখিল না। ছেলেকে বলিল, আয় বোস পাতে-হয়েচে, আমার। আয়—
অপু খাইতে বসিয়া বলিল, বেশ ভালো হয়, না মা? পাঁচ টাকা করে মইনে। তুমি জমিয়ো। তারপর মাইনে বাড়াবে বলেচে। আমার বন্ধু সতীনদের বাড়ির পাশে খোলার ঘর ভাড়া আছে দুটাকা মাসে। সেখানে আমরা যাবো-এদের বাড়ি তোমার যা খাটুনি! ইস্কুল থেকে আমনি চলে যাবো ইস্টিশানে-খাবার সেখানেই খাবো। কেমন তো?
সর্বজয়া বলিল-বুট করে দেবো, বেঁধে নিয়ে যাস।
দিন দশেক কাটিয়া গেল। আর কোন কথাবার্তা কোনো পক্ষেই উঠিল না। তাহার পর বড়োবাবু হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়িলেন এবং অত্যন্ত সঙ্গীন ও সংকটাপন্ন অবস্থার ভিতর দিয়া তাঁহার দিন-পনেরো কাটিল। বাড়িতে সকলের মুখে ঝি-চাকর দারোয়ানের মুখে বড়োবাবুর অসুখের বিভিন্ন অবস্থার কথা ছাড়া আর অন্য কথা নাই।
বড়োবাবু সামলাইয়া উঠিবার দিনকয়েক পর একদিন অপু আসিয়া হাসি-হাসি মুখে মাকে বলিল, আজ মা, বুঝলে, একটা ঘুড়ির দোকানে বলেচে যদি আমি বসে বসে ঘুড়ি জুড়ে দি আঠা দিয়ে, তারা সাত টাকা করে মাইনে আর রোজ দু-খানা করে ঘুড়ি দেবে। মস্ত ঘুড়ির দোকান, ঘুড়ি তৈরি করে কলকাতায় চালান দেয়-সোমবারে যেতে বলেচে–
এ আশার দৃষ্টি এ হাসি এ সব জিনিস সর্বজয়ার অপরিচিত নয়। দেশে নিশ্চিন্দিপুরের ভিটাতে থাকিতে কতদিন, দীর্ঘ পনেরো-ষোল বৎসব ধরিয়া মাঝে মাঝে কতবার স্বামীর মুখে এই ধরনের কথা সে শুনিয়াছে। এই সুর, এই কথার ভঙ্গি সে চেনে। এইবার একটা কিছু লাগিয়া যাইবেএইবার ঘটিল, অল্পই দেরি। নিশ্চিন্দিপুরের যথাসর্বস্ব বিক্ৰয় করিয়া পথে বাহির হওয়ার মূলেও সেই সুরেরই মোহ।
চারি বৎসর এখনও পূর্ণ হয় নাই, এই দশা ইহাব মধ্যে। কিন্তু সর্বজয়া চিনিয়াও চিনিল না। আজ বহুদিন ধরিয়া তাহার নিজের গৃহ বলিয়া কিছু নাই, অথচ নারীর অস্তনিহিত নীড় বাঁধিবার পিপাসটুকু ভিতবে ভিতরে তাহাকে পীড়া দেয়। অবলম্বন যতই তুচ্ছ ও ক্ষণভঙ্গুর হউক, মন তাঁহাই আঁকড়াইয়া ধরিতে ছুটিয়া যায়, নিজেকে ভুলাইতে চেষ্টা করে।
তাহা ছাড়া পুত্রের অনভিজ্ঞ মনের তরুণ উল্লাসকে পরিণত বয়সের অভিজ্ঞতাব চাপে শ্বাসরোধ করিয়া মারিতে মায়াও হয়।
সে বলিল, তা যাস না সোমবারে! বেশ তো,-দেখে আসিস। হ্যাঁ শুনিস নি, মেজ বৌরানী যে শিগগির আসচেন, আজ শূনছিলাম রান্না-বাড়িতে
অপুর চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, আগ্রহের সুরে জিজ্ঞাসা করিল, কবে মা, কবে?
–এই মাসের মধ্যেই আসবেন। বড়োবাবুর শরীর খারাপ, কাজ-টাজ দেখতে পারেন না, তাই মেজবাবু এসে থাকবেন দিন-কতক।
লীলা আসিবে কি-না একথা দুই-দুইবার মাকে বলি বলি করিয়াও কি জানি কেন সে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না। বাহিরে যাইতে যাইতে মনে মনে ভাবিল, তাদের বাড়িতে সবাই আসচে, মা বাবা আসচে, আর সে কি সেখানে পড়ে থাকবে? সে-ও আসবে।-ঠিক আসবে।
পরদিন সে স্কুল হইতে ফিরিয়া তাহদের ঘরটাতে ঢুকিতেই তাহার মা বলিল, অপু, আগে খাবার খেয়ে নে। আজ একখানা চিঠি এসেচে, দেখাচ্চি।
অপু বিস্মিতমুখে বলিল, চিঠি? কোথায়? কে দিয়েচে মা?
কাশীতে তাহার বাবার মৃত্যুর পর হইতে এ পর্যন্ত আজি আড়াই বৎসরের উপর এ বাড়িতে তাহারা আসিয়াছে, কই, কেহ তো একখানা পোস্টকর্ডে একছত্ৰ লিখিয়া তাহাদের খোঁজ করে নাই? লোকের যে পত্র আসে, একথা তাহারা তো ভুলিয়াই গিয়াছে!
সে বলিল, কই দেখি?
পত্ৰ-তা আবার খামে। খামিটার উপরে মায়ের নাম লেখা। সে তাড়াতাড়ি পত্ৰখানা খাম হইতে বাহির করিয়া অধীর আগ্রহের সহিত সেখানাকে পড়িতে লাগিল। পড়া শেষ করিয়া বুঝিতেনা-পারার দৃষ্টিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, ভবতারণ চক্রবর্তী কে মা?—পরে পত্রের উপরকার ঠিকানাটা আর একবার দেখিয়া বলিল, কাশী থেকে লিখেচে।
সর্বজয়া বলিল, তুই তো ওঁকে নিচিন্দিপুরে দেখেচিস!—সেই সেবার গেলেন, দুয়াকে পুতুলের বাক্স কিনে দিয়ে গেলেন, তুই তখন সাত বছরের। মনে নেই তোর? তিনদিন ছিলেন আমাদের বাড়ি।
–জানি মা, দিদি বলতো তোমার জ্যাঠামশায় হন-না? তা এতদিন তো আর কোনও—
–আপন নয়, দূর সম্পর্কের। জ্যাঠামশায় তো দেশে বড়ো-একটা থাকতেন না, কাশী-গয়া, ঠাকুর-দেবতার জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন, এখনও বেড়ান। ওঁদের দেশ হচ্চে মনসাপোতা, আড়ংঘাটার কাছে। সেখেন থেকে ক্রোশ দুই-সেবার আড়ংঘাটায় যুগল দেখতে গিয়ে ওঁদের বাড়ি গিয়ে ছিলাম দু-দিন। বাড়িতে মেয়ে-জামাই থাকত। সে মেয়ে-জামাই তো লিখেচেন মারা গিয়েচেছেলেপিলে কাবুর নেই–
অপু বলিল, হ্যাঁ, তাই তো লিখেচেন। নিশ্চিন্দিপুরে গিয়ে আমাদের খোজ করেচেন। সেখানে শূনেচেন কাশী গিাইচি। তারপর কাশীতে গিয়ে আমাদের সব খবর জেনেচেনি। এখানকার ঠিকানা নিয়েচেন বোধ হয়। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে।
সর্বজয়া হাসিয়া বলিল-আমি দুপুরবেলা খেয়ে একটু বলি গড়াই—ক্ষেমিঝি বললে তোমার একখানা চিঠি আছে। হাতে নিয়ে দেখি আমার নাম-আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। তারপব খুলে পড়ে দেখি এই—নিতে আসবেন লিখচেন শিগগির। দ্যাখা দিকি, কবে আসবেন লেখা আছে কিছু?