দেবব্রত বলিল, না, যাবেন না অপূর্বদা, কেন ওদের সঙ্গে মেশেন? আপনার নামে লাগিয়েচে, ধোপার পয়সা দেয় না, পয়সা বাকি রাখে এই সব! যাবেন না। ওদের ওখানে–
–কে বলেচে এসব কথা?
–ওই ওরাই বলে। বিনোদ ধোপাকে শিখিয়ে দিচ্ছিল। আপনার কাছে পয়সা বাকি না রাখতে। বলছিল, ও আর দেবে না-তিনবারের পয়সা নাকি বাকি আছে?
অপু বলিল-বা রে, বেশ লোক তো সব! হাতে পয়সা ছিল না। তাই দিইনি-এই সামনের মাসে প্রথমেই দিয়ে দেবো।–তা আবার ধোপাকে শিখিয়ে দেওয়া-আচ্ছা তো সব।
দেবব্রত বলিল-আবার আপনি ওদের যান খাওয়াতে! আপনার সেই খাতাখানা নিয়ে ওই বদমাইশ হিমাংশুটা আজ কত ঠাট্টা তামাশা করছিল-ওদের দেখান কেন ওসব?
অপূর্ব বলিল—এসব কথা আমি জানি নে, আমি লিখছিলাম ননীমাধব এসে বলে-ওটা কি? তাই একটুখানি পড়ে শোনালাম। কি কি-কি বলছিল?
–আপনাকে পাগল বলে-যন্ত রাজ্যির গাছপালার কথা নাকি শুধু শুধু খাতায় লেখা! আবোল-তাবোল শুধু তাতেই ভর্তি? ওরা তাই নিয়ে হাসে। আপনি চুপ করে এইখানে মাঝে মাঝে এসে বসেন বলে কত কথা তুলেছে
অপুর রাগ হইল, একটু লজ্জাও হইল। ভাবিল, খাতাখানা না দেখালেই হত সেদিন! দেখতে চাইলে তাই তো দেখলাম, নইলে আমি সোধে তো আর
মাঝে মাঝে তাহার মনে কেমন একটা অস্থিরতা আসে, এসব দিনে বোর্ডিং-এর ঘরে আবদ্ধ থাকিতে মন চাহে না। কোথায় কোন মাঠ বৈকালের রোদে রাঙা হইয়া উঠিয়াছে, ছায়াভিরা নদীজলে কোথায় নববধূর নাকছবির মতো পানকলস শ্যাওলার কুচ কুচা সাদা ফুল ফুটিয়া নদীজল আলো করিয়া রাখিয়াছে, মাঠের মাঝে উঁচু ডাঙায় কোথায় ঘেটুফুলের বন.এই সবের স্বপ্নে সে বিভোর থাকে, মুক্ত আকাশ, মুক্ত মাঠ, গাছপালার জন্য মন কেমন করে। গাছপালা না দেখিয়া বেশীদিন থাকা তাহার পক্ষে একেবারে অসম্ভব! মনে বেশি কষ্ট হইলে একখানা খাতায় সে বসিয়া বসিয়া যত রাজ্যের গাছের ও লতাপাতার নাম লেখে এবং যে ধরনের ভুমিশ্ৰীীর জন্য মনটা তৃষিত থাকে, তাহারই একটা কল্পিত বৰ্ণনায় খাতা ভরাইয়া তোলে। সেখানে নদীর পাশেই থাকে মাঠ, বাবলা বন, নানা বনজ গাছ, পাখিডাকা সকাল-বিকালের রোদ… ফুল। ফুলের সংখ্যা থাকে না। বোর্ডিং-এর ঘরটায় আবদ্ধ থাকিয়াও মনে মনে সে নানা অজানা মাঠে বনে নদীতীরে বেড়াইতে আসে। একখানা বাঁধা খাতাই সে এভাবে লিখিয়া পুরাইয়া ফেলিয়াছে!
অপু ভাবিল, বলুক গে, আর কখখনো কিছু দেখাচ্ছি নে। ওদের সঙ্গে এই আমার হয়ে গেল। দেবো। আবার কখনও ক্লাসের ট্রানস্লেশন বলে!
০৩. ফাল্গুন মাসের প্রথম হইতেই
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ফাল্গুন মাসের প্রথম হইতেই স্কুল কম্পাউন্ডের চারিপাশে গাছপালার নতুন পাতা গজাইল। ক্রিকেট খেলার মাঠে বড়ো বাদাম গাছটার রক্তাভ কচি সবুজ পাতা সকালের রৌদ্রে দেখিতে হইল চমৎকার, শীত একেবারে নাই বলিলেই হয়।
বোর্ডিং-এর রাসবিহারীর দল পরামর্শ করিল মাম্জোয়ানে দোলের মেলা দেখিতে যাইতে হইবে। মামূজোয়ানের মেলা এ অঞ্চলের বিখ্যাত মেলা।
অপু খুশির সহিত রাসবিহারীদের দলে ভিড়িল। মাম্জোয়ানের মেলার কথা অনেক দিন হইতে সে শুনিয়া আসিতেছে। তাহা ছাড়া নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া পর্যন্ত কোথাও মেলা বা বারোয়ারি আর কখনও দেখা ঘটে নাই।
সুপারিন্টেন্ডেন্ট বিধুবাবু দু-দিনের ছুটি দিলেন। অপু অনেকদিন পরে যেন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। ক্রোশ তিনেক পথ-মাঠ ও কাঁচা মাটির রাস্তা। ছোট ছোট গ্রাম, কুমারেরা চাক ঘুরাইয়া কলসি গড়িতেছে। পথের ধারের ছোট দোকানে দোকানদার রেড়ির ফলের বীজ ওজন করিয়া লইতেছে—সজিনা গাছ সব ফুলে ভর্তি—এমন চমৎকার লাগে।…ছুটি-ছাটা ও শনি-রবিবারে সীমাবদ্ধ না হইয়া এই যে জীবনধারা পথের দুইপাশে, দিনে রাত্রে, শত দুঃখে সুখে আকাশ বাতাসের তলে, নিরাবরণ মুক্ত প্রকৃতির সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাতাইয়া চঞ্চল আনন্দে ছুটিয়া চলিয়াছে—এই জীবনধারার সহিত সে নিজেকে পরিচিত করিতে চায়।
মাঠে কাহারা শুকনা খেজুর ডালের আগুনে রস জ্বাল দিতেছে দেখিয়া তাহার ইচ্ছা হইল— সে তাহাদের কাছে গিয়া খানিকক্ষণ রস জ্বাল দেওয়া দেখিবে, বসিয়া বসিয়া শুনিবে উহারা কি কথাবার্তা বলিতেছে।
ননী বলিল, তোকে পাগল বলি কি আর সাধে? দূর, দূর-আর কি দেখবি ওখানে?
অপু অপ্রতিভ মুখে বলিল, আয় না, ওরা কি বলছে শুনি? ওরা কত গল্প জানে, জানিস? আয় না
রাজু রায়ের পাঠশালার সেই দিনগুলি হইতে বয়স্ক লোকের গল্পের ও কথাবার্তার প্রতি তাহার প্রবল মোহ আছে-একটা বিস্তৃততর, অপরিচিত জীবনের কথা ইহাদের মুখে শোনা যায়। অপু ছাড়িয়া যাইতে রাজি নয়—রাসবিহারীর দল অগত্যা তাহাকে ফেলিয়া চলিয়া গেল।
সুশ্রী চেহারার ভদ্রলোকের ছেলে দেখিয়া মুচিরা খুব খাতির করিল। খেজুর রস খাইতে আসিয়াছে ভাবিয়া মাটির নতুন ভাড় ধুইয়া জিরান কাঠের টাটকা রস লইয়া আসিল। ইহাদের কাছে অপু আদৌ মুখচোরা নয়। ঘন্টাখানেকের উপর সে তাহাদের সেখানে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া গুড় জ্বাল দেওয়া দেখিল।
মাম্জোয়ানের মেলায় পৌঁছিতে তাহার হইয়া গেল বেলা বারোটা। প্রকাণ্ড মেলা, ভয়ানক ভিড়; রৌদ্রে তিন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া মুখ রাঙা হইয়া গিয়াছে, সঙ্গীদের মধ্যে কাহাকেও সে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিল না। ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দুই-ই পাইয়াছে, ভালো খাবার খাইবার পয়সা নাই, একটা দোকান হইতে সামান্য কিছু খাইয়া এক ঘটি জল খাইল। তাহার পর একটা পাখির খেলার তাঁবুর ফাঁক দিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল—ভিতরে কি খেলা হইতেছে। একজন পশ্চিমা লোক হটাইয়া দিতে আসিল।