মহা খুশির সহিত তাহাদিগকে বাজারে লইয়া গিয়া খাবার খাওয়ায়। ইহার উপর আবার কেহ। কেহ ধার করিতে আসে, অপু কাহাকেও না’ বলিতে পারে না।
এরূপ করিলে কুবেরের ভাণ্ডার আর কিছু বেশি দিন টিকিতে পারে বটে, কিন্তু একশত কুড়িটা পয়সা দশদিনের মধ্যেই নিঃশেষে উড়িয়া যায়, মাসের বাকি দিনগুলিতে কষ্ট ও টানাটানির সীমা থাকে না। দু-দশটা পয়সা যে যাহা ধার লয়, মুখচোরা অপু কাহারও কাছে তাগাদা করিতে পারে না,-প্রায়ই তাহা আর আদায় হয় না।
সমীর ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট হাতে বাহির হইয়া গেল। অপু ভাবিল-বলুক বোকা, আমি তো আর বোকা নাই! পয়সা ধার নিয়েচে কেন দেবে না-সবাই দেবে।
পরে সে একখানা বই হাতে লইয়া তাহার প্রিয় গাছপালা-ঘেরা সেই কোণটিতে বসিতে যায়। মনে পড়ে এতক্ষণ সেখানে ছায়া পড়িয়া গিয়াছে, চীনে-জবা গাছে কচি কচি পাতা ধরিয়াছে। যাইবার সময় ভাবে, দেখি আর কাঁটা লজেঞ্ছস আছে?-পরে বোতল হইতে গোটাকতক বাহির করিয়া মুখে পুরিয়া দেয়।–ভাবে, আসছে মাসের টাকা পেলে ওই যে আনারসের একরকম আছে, তাই কিনে আনিব এক শিশি-কি চমৎকার এগুলো খেতে! এ ধরনের ফলের আস্বাদযুক্ত লজেঞ্জুস সে আর কখনও খায় নাই!
কম্পাউন্ডে নামিয়া লাইব্রেরির কোণটা দিয়া যাইতে যাইতে সে হঠাৎ অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া গেল। একজন বেঁটেমতো লোক ইদারার কাছে দাঁড়াইয়া স্কুলের কেরানী ও বোর্ডিং-এর বাজার সরকার গোপীনাথ দত্তের সঙ্গে আলাপ করিতেছে।
তাহার বুকের ভিতরটা কেমন ছ্যাৎ করিয়া উঠিল.সে কিসের টানে যেন লোকটার দিকে পায়ে পায়ে আগাইয়া গেল.লোকটা এবার তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়াছে-হাতটা কেমন বাঁকাইয়া আছে, তখনই কথা শেষ করিয়া সে ইদারার পাড়ের গায়ে ঠেস-দেওয়ানো ছাতাটা হাতে লইয়া কম্পাউন্ডের ফটক দিয়া বাহির হইয়া গেল।
অপু খানিকক্ষণ একদৃষ্টি সেদিকে চাহিয়া রহিল। লোকটাকে দেখিতে অবিকল তাহার বাবার
কতদিন সে বাবার মুখ দেখে নাই। আজ চার বৎসর!
উদগত চোখের জল চাপিয়া জবাতলায় গিয়া সে গাছের ছায়ায় চুপ করিয়া বসিল।
অন্যমনস্কভাবে বইখানা সে উলটাইয়া যায়। তাহার প্রিয় সেই তিনরঙা ছবিটা বাহির করিল, পাশের পৃষ্ঠার সেই পদ্যটা।
স্বদেশ হইতে বহুদূরে, আত্মীয়স্বজন হইতে বহুদূরে, আলজিরিয়ার কর্কশ, বন্ধুর, জাহীন মরুপ্রান্তে একজন মুমূর্ষ তরুণ সৈনিক বালুশয্যায় শায়িত। দেখিবার কেহ নাই। কেবল জনৈক সৈনিকবন্ধু পাশে হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া মুখে চামড়ার বোতল হইতে একটু একটু জল দিঠেছে। পৃথিবীর নিকট হইতে শেষ বিদায় লইবার সময় সম্মুখের এই অপরিচিত, ধূসর উঁচুনিচু বালিয়াড়ি, পিছনের আকাশে সান্ধ্যসূৰ্যরক্তচ্ছটিা, দুরে খৰ্জ্জুরকুঞ্জ ও উর্ধ্বমুখ উক্ট্রশ্রেণীর দিকে চোখ রাখিয়া মুমূর্ষ। সৈনিকটির কেবলই মনে পড়িতেছে বহুদূরে রাইন নদীতীরবতী তাহার জন্মপল্লীর কথা…তাহার মা আছেন সেখানে। বন্ধু, তুমি আমার মায়ের কাছে খবরটা পৌঁছাইয়া দিয়ো, ভুলিয়ো না।…
For my home is in distant Bingen, Fair Birgen on the Rhine!
মাকে অপু দেখে নাই আজ পাঁচ মাসঃ-সে। আর থাকিতে পারে না…বোর্ডিং তাহার ভালো লাগে না, স্কুল আর ভালো লাগে না, মাকে না দেখিয়া আর থাকা যায় না।
এই সব সময়ে এই নির্জন অপরাহুগুলিতে নিশ্চিন্দিপুরের কথা কেমন করিয়া তাহার মনে পড়িয়া যায়। সেই একদিনের কথা মনে পড়ে।…
বাড়িতে পাশের পোড়ো ভিটার বনে অনেকগুলো ছাতারে পাখি কিচকিচ করিতেছিল, কি ভাবিয়া একটা চিল ছুঁড়িয়া মারিতেই দলের মধ্যে ছোট একটা পাখি ঘাড় মোচড়াইয়া টুপ করিয়া ঝোপের নিচে পড়িয়া গেল, বাকিগুলা উড়িয়া পলাইল। তাহার টিলে পাখি সত্য সত্য মরিবে ইহা সে ভাবে নাই, দৌড়িয়া গিয়া মহা আগ্রহে দিদিকে ডাকিল, ওরে দিদি, শিগগির আয় রে, দেখবি একটা জিনিস, ছুটে আয়–
দুৰ্গা আসিয়া দেখিয়া বলিল, দেখি, দে-দিকি আমার হাতে! পরে সে নিজের হাতে পাখিটিকে লইয়া কৌতূহলের সহিত নাড়িয়া চড়িয়া দেখিল। ঘাড় ভাঙিয়া গিয়াছে, মুখ দিয়া রক্ত উঠিয়াছে, দুর্গার আঙুলে রক্ত লাগিয়া গেল। দুৰ্গা তিরস্কারের সুরে বলিল, আহা, কেন মারতে গেলি তুই?
অপুর বিজয়গর্বে উৎফুল্প মন একটু দমিয়া গেল।
দুর্গা বলিল, আজ কি বার রে? সোমবার না? তুই তো বামুনের ছেলে-চল, তুই আর আমি একে নিয়ে গিয়ে গাঙের ধারে পুড়িয়ে আসি, এর গতি হয়ে যাবে।
তারপর দুর্গা কোথা হইতে একটা দেশলাই সংগ্ৰহ করিয়া আনিল, তেঁতুলতলার ঘাটের এক ঝোপেব ধারে শূকনো পাতার আগুনে পাখিটাকে খানিক পুড়াইল, পরে আধঝলসানো পাখিটা নদীর জলে ফেলিয়া দিয়া সে ভক্তিভাবে বলিল-হরিবোল হরি, হবি ঠাকুর ওর গতি করবেন, দেখিস! আহা, কি করেই ঘাড়টা থেতলে দিয়েছিলি? কখখনো ওরকম করিস নে আর। বনে জঙ্গলে উড়ে বেড়ায়, কাবুর কিছু করে না, মারতে আছে, ছিঃ!–
নদী হইতে অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিয়া দুৰ্গা চিতার জায়গাটা ধুইয়া দিল।
সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরিবার সময় কে জানে তাহারা কোন মুক্ত বিহঙ্গ আত্মার আশীৰ্বাদ লইয়া ফিবিয়াছিল!…
দেবব্রত আসিয়া ডাক দিতে অপুর নিশ্চিন্দিপুরের স্বপ্ন মিলাইয়া গেল।
দেবব্রত বলিল, অপুর্বদা এখানে বসে আছেন? আমি ঠিক ভেবেচি আপনি এখানেই আছেন-কি কথা ভাবচোন-মুখ ভার-ভার–
অপু হাসিয়া বলিল-ও কিছু না, এসো বোসো। কি? চলো দেখি রাসবেহারী কি করছে।