অপু আগ্রহের সঙ্গে শুনিতে বসিলা। কখন সে বাড়ি পৌঁছিলা? রাত কত হইয়াছিল, তাহার মা তখন কি করিতেছিলেন?-ইত্যাদি।
রাত অনেক হইয়াছিল। বাড়িতে রাতের খাওয়া প্ৰায় শেষ হয় হয়। তাহার মা ছোট ভাইকে প্রদীপ ধরিয়া রান্নাঘর হইতে বড়োঘরের রোয়াকে পৌঁছাইয়া দিতেছেন এমন সময়
অপু কত দিন নিজে বাড়ি যায় নাই। মাকে কত দিন সে দেখে নাই। ইহার মতো হ্যাঁটিয়া যাতায়াতের পথ হইলে এতদিনে কতবার যাইত। রেলগাড়ি, গহনার নৌকা, আবার খানিকটা হাঁটাপথও। যাতায়াতে দেড় টাকা খরচ, তাহার এক মাসের জলখাবার। কোথায় পাইবে দেড় টাকা যে, প্রতি শনিবার তো দূরের কথা, মাসে অন্তত একবারও বাড়ি যাইবে! জলখাবারের পয়সা বাঁচাইয়া আনা আষ্টেক পয়সা হইয়াছে, আর এক টাকা হইলেই-বাড়ি। হয়তো এক টাকা জমিতে জমিতে গরমের দুটিই বা আসিয়া যাইবে, কে জানে?
পরদিন স্কুলে হৈ হৈ ব্যাপার। দেবব্রত যে লুকাইয়া কাহাকেও না বলিয়া বাড়ি চলিয়া গিয়াছিল এবং রবিবার রাত্রে লুকাইয়া বোর্ডিং-এ ঢুকিয়াছে, সে কথা কি করিয়া প্রকাশ হইয়া গিয়াছে। বিধুবাবু সুপারিন্টেন্ডেন্ট-সে কথা হেডমাস্টারের কানে তুলিয়াছেন। ব্যাপারের গুরুত্ব বুঝিয়া সমীরের প্রাণ ভয়ে উড়িয়া গেল, সেই যে জানালার ভাঙা গরাদ খুলিয়া দেবব্রতকে তাহাদের ঘরে ঢুকাইয়া লইয়াছে, সে কথা হেডমাস্টার জানিতে পারিলে কি আর রক্ষা থাকিবে? সমীর রমাপতির ঘরে গিয়া অবস্থাটা বুঝিয়া আসিল। দেবব্রত নিজেই সব স্বীকার করিয়াছে, সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় নাই, কিন্তু সমীরের জানোলা খুলিয়া দেওয়ার কথা কিছুই বলে নাই। বলিয়াছে, সে সোমবার খুব ভোরে চুপি চুপি লুকাইয়া বোর্ডিং-এ ঢুকিয়াছে, কেহ টের পায় নাই। স্কুল বসিলে ক্লাসে ক্লাসে হেডমাস্টারের সাকুলার গেল যে, টিফিনের সময় স্কুলের হলে দেবব্রতকে বেত মারা হইবে, সকল ছাত্র ও টিচারদের সে সময় সেখানে উপস্থিত থাকা চাই।
সমীর গিয়া রমাপতিকে বলিল, আপনি একবার বলুন না। রমাপতিদা হেডমাস্টারকে, ও ছেলেমানুষ, থাকতে পারে না বাড়ি না গিয়ে, আপনি তো জানেন ও কি রকম home-sick? মিথ্যে মিথ্যে ওকে তিন শনিবার ছুটি দিলে না। সেকেন মাস্টার, ওর কি দোষ?
উপর-ক্লাসের ছাত্রদের ডেপুটেশনকে হেডমাস্টার হ্যাঁকাইয়া দিলেন। টিফিনের সময় সকলে হলে একত্র হইলে দেবব্রতকে আনা হইল। ভয়ে তাহার মুখ শুকাইয়া ছোট হইয়া গিয়াছে। হেডমাস্টার বঞ্জ গভীর স্বরে ঘোষণা করিলেন যে, এই প্রথম অপরাধ বলিয়া তিনি শুধু বেত মারিয়াই ছাড়িয়া দিতেছেন নতুবা স্কুল হইতে তাড়াইয়া দিতেন।–রীতিমতো বেত চলিল। কয়েক ঘা বেত খাইবার পরই দেবব্রত চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। হেডমাস্টার গর্জন করিয়া বলিলেন, চুপ।। Bend this way, bend! মারা দেখিয়া বিশেষ করিয়া দেবব্রতের কান্নায় অপুর চোখে জল আসিয়া গেল। মনে পড়িল, লীলাদের বাড়ি এই রকম মার একদিন সেও খাইয়াছিল বড়োবাবুর কাছে, সেও বিনা দোষে।
অপু উঠিয়া বারান্দায় গেল। ফিরিয়া আসিতে সমীর ধমক দিয়া চুপি চুপি বলিল, তুই ও-রকম কঁদেছিস কেন অপূর্ব? থাম না-হেডমাস্টার বকবে—
সরস্বতী পূজার সময় তাহার আট আনা চাদা ধরাতে অপু বড়ো বিপদে পড়িল। মাসের শেষ, হাতেও পয়সা তেমন নাই, অথচ সে মুখে কাহাকেও না’ বলিতে পারে না, সরস্বতী পূজার চাঁদা দিয়া হাত একেবারে খালি হইয়া গেল। বৈকালে সমীর জিজ্ঞাসা করিল, খাবার খেতে গেলি নে অপূর্ব?
সে হাসিয়া ঘাড় নাড়িল।
সমীর তাহার সব খবর রাখে, বলিল, আমি বরাবর দেখে আসচি অপূর্ব হাতের পয়সা ভারি বে-আন্দাজি খরচ করিস তুই—বুঝেসুঝে চললে এরকম হয় না-আট আনা চাঁদা কে দিতে বলেছে?
অপু হাসিমুখে বলিল, আচ্ছা, আচ্ছা, যা তোকে আর শেখাতে হবে না-ভারি। আমার গুরুঠাকুর–
সমীর বলিল, না হাসি নয়, সত্যি কথা বলছি। আর এই ননী, ভুলো, রাসবেহারী-ওদের ও রকম বাজারে নিয়ে গিয়ে খাবার খাওয়াস কেন?
অপু তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলি, যাঃ বকিস নে-ওরা ধরে খাওয়াবার জন্যে, তা করব কি?
সমীর রাগ করিয়া বলিল, খাওয়াতে বললেই অমনি খাওয়াতে হবে? ওরাও দুষ্ট্রর ধাড়ি, তোকে পেয়েছে ওই রকম তাই। অন্য কারুর কাছে তো কই ঘেঁষে না। আড়ালে তোকে বোকা বলে তা জানিস!
-হ্যাঁ বলে বইকি!
–আমার মিথ্যে কথা বলে লাভ? সেদিন মণিদার ঘরে তোর কথা হচ্ছিল। ওই বদমায়েশ রাসবেহারটা বলছিল-ফাঁকি দিয়ে খেয়ে নেয়,–আর ও-সব কলার লজেঞ্জুস কিনে এনে বিলিয়ে বাহাদুরি করতে কে বলেছে তোকে?
সমীর নিতান্ত মিথ্যা বলে নাই। জীবনে এই প্রথম নিজের খরচপত্র অপুকে নিজে বুঝিয়া করিতে হইতেছে, ইহার পূর্বে কখনও পয়সাকড়ি নিজের হাতের মধ্যে পাইয়া নাড়াচাড়া করে নাইকাজেই সে টাকা-পয়সার ওজন বুঝিতে পারে না, স্কলারশিপের টাকা হইতে বোর্ডিং-এর খরচ মিটাইয়া টাকা-দুই হাতখরচের জন্য বাঁচে–এই দেড় টাকা দুটাকাকে সে টাকার হিসাবে না দেখিয়া পয়সার হিসাবে দেখিয়া থাকে। ইতিপূর্বে কখনও আটটা পয়সা একত্র হাতের মধ্যে পায় নাই–একশো কুড়িটা পয়সা তাহার কাছে কুবেরের ধনভাণ্ডারের সমান অসীম মনে হয়। মাসের প্রথমে ঠিক রাখিতে না পারিয়া সে দরাজ হাতে খরচ করে-বাঁধানো খাতা কেনে, কালি কেনে, খাবার খায়। প্রায়ই দু-চারজন ছেলে আসিয়া ধরে তাহাদিগকে খাওয়াইতে হইবে। তাহার খুব প্রশংসা করে, পড়াশুনার তারিফ করে! অপু মনে মনে অত্যন্ত গর্ব অনুভব করে, ভাবে।–সোজা ভালো ছেলে আমি! সবাই কি খাতির করে! তবুও তো মোটে পাঁচ মাস এসিচি!