নদীর ধারে আজিকার এই আসন্ন সন্ধ্যায় মৃত্যুর নব রূপ সে দেখিতে পাইল। মনে হইল, যুগে যুগে এ জন্মমৃত্যুচক্র কোন্ বিশাল-আত্মা দেবশিল্পীর হাতে আবর্তিত হইতেছে—তিনি জানেন কোন জীবনের পর কোন অবস্থার জীবনে আসিতে হয়, কখনও বা সঙ্গতি, কখনও বা বৈষম্য—সবটা মিলিয়া অপূর্ব রসসৃষ্টি-বৃহত্তর জীবনসৃষ্টির আর্ট
ছহাজার বছর আগে হয়তো সে জন্মিয়াছিল প্রাচীন ঈজিপ্টে—সেখানে নলখাগড়া প্যাপিরাসের বনে, নীলনদের রৌদ্রদীপ্ত তটে কোন্ দরিদ্রঘরের মা বোন বাপ ভাই বন্ধুবান্ধবদের দলে কবে সে এক ধূসর শৈশব কাটাইয়া গিয়াছে—আবার হয়তো জন্ম নিয়াছিল রাইন নদীর ধারে কর্ক-ওক, বার্চ ও বীচবনের শ্যামল ছায়ায় বনেদী ঘরের প্রাচীন প্রাসাদে, মধ্যযুগের আড়ম্বরপূর্ণ আবহাওয়ায়, সুন্দরমুখ সখীদের দল। হাজার বছর পর আবার হয়তো সে পৃথিবীতে ফিরিয়া আসিবে–তখন কি মনে পড়িবে এবারকারের এই জীবনটা? কিংবা কে জানে আর হয়তো এ পৃথিবীতে আসিবে না—ওই যে বটগাছের সারির মাথায় সন্ধ্যার ক্ষীণ প্রথম তারকাটি—ওদের জগতে অজানা জীবনধারার মধ্যে হয়তো এবার নবজন্ম!—কতবার যেন সে আসিয়াছে….জন্ম হইতে জন্মান্তরে, মৃত্যু হইতে মৃত্যুর মধ্য দিয়া…বহু দূর অতীতে ও ভবিষ্যতে বিস্মৃত সে পথটা যেন বেশ দেখিতে পাইল…কত নিশ্চিন্দিপুর, কত অপর্ণা, কত দুর্গা দিদি-জীবনের ও জন্মমৃত্যুর বীথিপথ বাহিয়া ক্লান্ত ও আনন্দিত আত্মার সে কি অপরুপ অভিযান…শুধু আনন্দে, যৌবনে, জীবনে, পুণ্যে ও দুঃৰে, শোকে ও শান্তিতে।…এই সবটা লইয়া যে আসল বৃহত্তর জীবন—পৃথিবীর জীবনটুকু যার ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র—তার স্বপ্ন যে শুধুই কল্পনাবিলাস, এ যে হয় তা কে জানে-বৃহত্তর জীবনচক্র কোন্ দেবতার হাতে আবর্তিত হয় কে জানে?…হয়তো এমন সব প্রাণী আছেন যারা মানুষের মতো ছবিতে, উপন্যাসে, কবিতায় নিজেদের শিল্পসৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন না—তারা এক এক বিশ্ব সৃষ্টি করেন—তার মানুষের সুখে-দুঃখে উখানে-পতনে আত্মপ্রকাশ করাই তাদের পদ্ধতি-কোন্ মহান বিবর্তনের জীব তার অচিন্তনীয় কলাকুশলতাকে গ্রহে গ্রহে নক্ষত্রে নক্ষত্রে এ-রকম রূপ দিয়াছেন কে তাঁকে জানে?…
একটি অবর্ণনীয় আনন্দে, আশায়, অনুভূতিতে, রহস্যে মন ভরিয়া উঠিল। প্রাণবন্ত তার আশা, সে অমর ও অনন্ত জীবনের বাণী বনলতার রৌদ্রদগ্ধ শাখাপত্রের তিক্ত গন্ধ আনেশীলশূন্যে বালিহাঁসের সাঁই সাঁই রব শোনায়। সে জীবনের অধিকার হইতে তাহাকে কাহারও বঞ্চনা করিবার শক্তি নাই—তার মনে হইল সে দীন নয়, দুঃখী নয়, তুচ্ছ নয়-ওটুকু শেষ নয়, এখানে আরও নয়। সে জন্মজন্মান্তরের পথিক আত্মা, দূর হইতে কোন সুদূরের নিত্য নূতন পথহীন পথে তার গতি, এই বিপুল নীল আকাশ, অগম্য জ্যোতিলোক, সপ্তর্ষিমণ্ডল, হায়াপথ, বিশাল অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার জগৎ, বহিৰ্যদ পিতৃলোক—এই শত সহস্র শতাব্দী, তার পায়ে-চলার পথতার ও সকলের মৃত্যুদ্বারা অস্পষ্ট সে বিরাট জীবনটা নিউটনের মহাসমুদ্রের মতো সকলেরই পুরোভাগে অক্ষুন্ন ভাবে বর্তমান-নিঃসীম সময় বাহিয়া সে গতি সারা মানবের যুগে যুগে বাধাহীন হউক।…
অপু তাহাদের ঘাটের ধারে আসিল। ওইখানটিতে এমন এক সন্ধ্যার অন্ধকারে বনদেবী বিশালাক্ষী স্বরূপ চক্রবর্তীকে দেখা দিয়েছিলেন কতকাল আগে।
আজ যদি আবার তাহাকে দেখা দেন।
-তুমি কে?
—আমি অপু।
–তুমি বড়ো ভালো ছেলে। তুমি কি বর চাও?
–অন্য কিছুই চাই নে, এ গাঁয়ের বনঝোপ, নদী, মাঠ, বাঁশবনের ছায়ায় অবোধ, উগ্রীব, স্বপ্নময় আমার সেই যে দশ বৎসর বয়সের শৈশবটি—তাকে আর একটিবার ফিরিয়ে দেবে দেবী?–
“You enter it by the Ancient way
Through Ivory Gate and golden”
ঠিক দুপুর বেলা।
রানী কাজলকে আটকাইয়া রাখিতে পারে না–বেজায় চঞ্চল। এই আছে, কোথা গিযা যে কখন বাহির হইয়া গিয়াছে—কেহ বলিতে পারে না।
সে রোজ জিজ্ঞাসা করে পিসিমা, বাবা কবে আসবে? কতদিন দেরি হবে?
অপু যাইবার সময় বলিয়া গিয়াছিল-রানুদি, খোকাকে তোমার হাতে দিয়ে যাচ্ছি, ওকে এখানে রাখবে, ওকে বোলো না আমি কোথা যাচ্ছি। যদি আমার জন্য কাঁদে, ভুলিয়ে রেখো তুমি ছাড়া ও-কাজ আর কেউ পারবে না।
রানু চোখ মুছিয়া বলিয়াছিল—ওকে এ-রকম ফাঁকি দিতে তোর মন সরছে? বোকা ছেলে তাই বুঝিয়ে গেলি—যদি চালাক হত?
অপু বলিয়াছিল, দেখ আর একটা কথা বলি। ওই বাঁশবনের জায়গাটা—তোমায় চল দেখিয়ে রাখি—একটা সোনার কৌটো মাটিতে পোঁতা আছে আজ অনেকদিন-মাটি খুঁড়লেই পাবে। আর যদি না ফিরি আর খোকা যদি বাঁচে-বৌমাকে কৌটোটা দিয়ো সিঁদুর রাখতে। খোকাও কষ্ট পেয়ে মানুষ হোক—এত তাড়াতাড়ি স্কুলে ভর্তি করবার দরকার নেই। যেখানে যায় যেতে দিয়ো-কেবল যখন ঘাটে যাবে, তুমি নিজে নাইতে নিয়ে যেয়ো-সাঁতার জানে না, ছেলেমানুষ ডুবে যাবে। ও একটু ভীতু আছে, কিন্তু সে ভয় এ নেই তা নেই বলে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা কোরো না—কি আছে কি নেই তা বলতে কেউ পারে না রানুদি। কোনোদিবই গোঁড়ামি ভালো নয়—তা ওর ওপর চাপাতে যাওয়ারও দরকার নেই। যা বোঝে বুঝুক, সেই ভালো।
অপু জানিত, কাজল শুধু তার কল্পনা-প্রবণতার জন্য ভীতু। এই কাল্পনিক ভয় সকল আনন্দ রোমান্স ও অজানা কল্পনার উৎসমুখ। মুক্ত প্রকৃতির তলায় থোকার মনের সব বৈকাল ও রাত্রিগুলি অপূর্ব রহস্যে রঙিন হইয়া উইক-মনেপ্রাণে এই তাহার আশীর্বাদ।