রানুর মেয়ে বলিল—ও মামা, আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে আজ এইলোপেলেন গিইল।
কাজল বলিল-হা বাবা, আজ দুপুরে। এই তেঁতুল গাছের ওপর দিয়ে গেল।
অপু বলিল—সত্যি রানুদি?
-হাঁ তাই। কি ইংরেজি বুঝিনে-উড়ো জাহাজ যাকে বলে–কি আওয়াজটা!
নিশ্চিন্দিপুরের সাত বছরের মেয়ে আজকাল এরোপ্লেন দেখিতে পায় তাহা হইলে?
পরদিন সন্ধ্যার পর জ্যোৎস্নারাত্রে অভ্যাসমতো নদীর ধারের মাঠে বেড়াইতে গেল।
কতকাল আগে নদীর ধারের ওইখানটিতে একটা সাঁইবাবলাতলায় বসিয়া এইরকম বৈকালে সে মাছ ধরিত—আজকাল সেখানে সাঁইবাবলার বন, ছেলেবেলার সে গাছটা আর চিনিয়া লওয়া যায় না।
ইছামতী এই চঞ্চল জীবনধারার প্রতীক। ওর দুপাড় ভরিয়া প্রতি চৈত্র বৈশাখে কত বনকুসুম, গাছপালা, পাখ-পাখালি, গায়ে গায়ে গ্রামের ঘাট–শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া কত ফুল ঝরিয়া পড়ে, কত পাখির দল আসে যায়, ধারে ধারে কত জেলেরা জাল ফেলে, তীরবর্তী গৃহস্থবাড়িতে হাসি-কান্নার লীলাখেলা হয়, কত গৃহস্থ আসে, কত গৃহস্থ যায়—কত হাসিমুখ শিশু মায়ের সঙ্গে মাহিতে নামে, আবার বৃদ্ধাবস্থায় তাহাদের নশ্বর দেহের রেণু কলম্বনা ইছামতীর স্রোতোজলে ভাসিয়া যায়—এমন কত মা, কত ছেলেমেয়ে, তরুণতরুণী মহাকালের বীথিপথে আসে যায়—অথচ নদী দেখায় শান্ত, স্নিগ্ধ, ঘরোয়া, নিরীহ।…
আজকাল নির্জনে বসিলেই তাহার মনে হয়, এই পৃথিবীর একটা আধ্যাত্মিক রূপ আছে, এব ফুলফল, আলোছায়ার মধ্যে জন্মগ্রহণ করার দরুন এবং শৈশব হইতে এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ থাকার দরুন এর প্রকৃত রূপটি আমাদের চোখে পড়ে না। এ আমাদের দর্শন ও শ্রবণগ্রাহ্য জিনিসে গড়া হইলেও আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ও ঘোর রহস্যময়, এর প্রতি রেণু যে অসীম জটিলতায় আচ্ছন্নযা কিনা মানুষের বুদ্ধি ও কল্পনার অতীত, এ সত্যটা হঠাৎ চোখে পড়ে না। যেমন সাহেব বন্ধুটি বলিত, ভারতবর্ষের একটা রূপ আছে, সে তোমরা জানো না। তোমরা এখানে জন্মেছ কিনা, অতি পরিচয়ের দোষে সে চোখ ফোটে নি তোমাদের।
আকাশের রং আর এক রকম—দুরের সে গহন হিরাকসের সমুদ্র ঈষৎ কৃষ্ণাভ হইয়া উঠিয়াছের তলায় সারা সবুজ মাঠটা, মাধবপুরের বাঁশবনটা কি অপূর্ব, অদ্ভুত, অপার্থিব ধবনের ছবি ফুটাইয়া তুলিয়াছে!…ও যেন পরিচিত পৃথিবীটা নয়, অন্য কোন অজানা জগতের কোনও অজ্ঞাত দেবলোকের…
প্রকৃতির একটা যেন নিজস্ব ভাষা আছে। অপু দেখিয়াছে, কতদিন বক্রতোয়ার উপল ছাওয়াতটে শাল-ঝাড়ের নিচে ঠিক দুপুরে বসিয়াদুৱে নীল আকাশের পটভূমিতে একটা পত্রশূন্য প্রকাণ্ড কি গাছ—সেদিকে চাহিলেই এমন সব কথা মনে আসিত যা অন্য সময় আসার কল্পনাও করিতে পারিত না-পাহাড়ের নিচে বনফলের জঙ্গলেরও একটা কি বলিবার ছিল যেন। এই ভাষাটা ছবির ভাষা-প্রকৃতি এই ছবির ভাষায় কথা বলেন—এখানেও সে দেখিল গাছপালায়, উইঢিপির পাশে শুকনো খড়ের ঝোপে, দূরের বাঁশবনের সারিতে—সেই সব কথাই বলে—সেই সব ভাবই মনে আনে। প্রকৃতির এই ছবির ভাষাটা সে বোঝে। তাই নির্জন মাঠে, প্রান্তরে, বনের ধারে একা বেড়াইয়া সে যত প্রেরণা পায়-যে পুলক অনুভব করে তা অপূর্ব-সত্যিকাব Joy of Life-পায়ের তলায় শুকনো লতাকাটি, দেয়াড়ের চরে রাঙা-রোদ মাখানো কষাঢ় ঝোপ, আকন্দের বন, ঘেঁটুবন—তার আত্মাকে এরা ধ্যানের খোরাক জোগায়, এ যেন অদৃশ্য স্বাতী নক্ষত্রের বারি, তারই প্রাণে মুক্তার দানা বাঁধে।
সন্ধ্যার পূরবী কি গৌরীরাগিণীর মতো বিষাদ ভরা আনন্দ, নির্লিপ্ত ও নির্বিকার–বহুদূরের ওই নীল কৃষ্ণাভ মেঘরাশি, ঘন নীল, নিথর, গহন আকাশটা মনে যে ছবি আঁকে, যে চিন্তা জোগায়, তার গতি গোমুখী-গঙ্গার মতো অনন্তের দিকে, সে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কথা বলে, মৃত্যুপারের দেশের কথা কয়,ভালোবাসা-বেদনা-ভালোবাসিয়া হারানো-বহুদুরের এক প্রতিভরা পুনর্জন্মের বাণী…
এইসব শান্ত সন্ধ্যায় ইছামতীর তীরের মাঠে বসিলেই রক্তমেঘপ ও নীলাকাশের দিকে চাহিয়া চারিপাশের সেই অনত বিশ্বের কথাই মনে পড়ে। বাল্যে এই ফাটাভরা সাঁইবাবলার ছায়ায় বসিয়া মাছ ধরিতে ধরিতে সে দূর দেশের স্বপ্ন দেখিত–আজকাল চেতনা তাহার বাল্যের সে ক্ষুদ্র গণ্ডি পার হইয়া ক্রমেই দূর হইতে দূরে আলোকের পাখায় চলিয়াছে—এই ভাবিয়া এক এক সময় সে আনন্দ পায়—কোথাও না যাক—যে বিশ্বের সে একজন নাগরিক, তা ক্ষুদ্র, দীন বিশ্ব নয়। লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ যার গণনার মাপকাঠি, দিকে দিকে অন্ধকারে ডুবিয়া ডুবিয়া নক্ষত্রপুঞ্জ, নীহারিকাদের দেশ, অদৃশ্য ঈথারের বিশ্ব যেখানে মানুষের চিন্তাতীত, কল্পনাতীত দূরত্বের ক্রমবর্ধমান পরিধিপানে বিস্তৃত—সেই বিশ্বে সে জন্মিয়াছে…
ওই অসীম শূন্য কত জীবলোকে ভরা-কি তাদের অদ্ভুত ইতিহাস! অজানা নদীতটে প্রণয়ীদের কত অশ্রুভরা আনন্দতীর্থসারা শূন্য ভরিয়া আনন্দস্পন্দনের মেলা—ঈথারের নীল সমুদ্র বাহিয়া বহু দূরের বৃহত্তর বিশ্বের সে-সব জীবনধারার ঢেউ প্রাতে, দুপুরে, রাতে, নির্জনে একা বসিলেই তাহারা মনের বেলায় আসিয়া লাগে—অসীম আনন্দ ও গভীর অনুভূতিতে মন ভরিয়া উঠে-পরে সে বুঝিতে পারে শুধু প্রসারতার দিকে নয়—যদিও তা বিপুল ও অপরিমেয় কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চেতনা স্তরের আর একটা Dimension যেন তার মন খুঁজিয়া পায়—এই নিস্তব্ধ শরৎ দুপুর যখন অতীতকালের এমনি এক মধুর মুগ্ধ শৈশব দুপুরের ছায়াপাতে স্নিগ্ধ ও করুণ হইয়া উঠে তখনই সে বুঝিতে পারে চেতনার এ স্তর বাহিয়া সে বহুদূর যাইতে পারে—হয়তো কোন অজ্ঞাত সৌন্দর্যময় রাজ্যে, দৈনন্দিন ঘটনার গতানুগতিক অনুভূতিরাজি ও একঘেয়ে মনোভাব যে রাজ্যের সন্ধান দিতে পারিতই না কোনদিন।