বৈকালে খানিকটা বেড়াইল। বাকি চারশ টাকা আদায় হইল। আব কিছুদিন পব কলকাতা ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে কত দূর, সপ্তসিন্ধু পারের দেশ…কে জানে আর ফিরিবে কিনা? ভিটা-লেভু, তানি-লেভু, নিউ হেব্রিডিস-সামোয়া!—অর্ধচন্দ্রাকৃতি প্রবালবাধে ঘেরা নিস্তরঙ্গ ঘন নীল উপসাগর, একদিকে সিন্ধু সীমাহারা, অকূল!–দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত—অন্যদিকে ঘরোয়া ছোট্ট পুকুরের মতো উপসাগরটির তীরে নারিকেল পত্র নির্মিত ছোট ছোট কুটির মধ্যে লৌহ প্রস্তরের পাহাড়ের সূক্ষ্মাগ্র নাসা, উভয়কে দ্বিধাবিভক্ত করিতেছে-রৌদ্রালোকপ্লাবিত সাগরবেলা। পথিক জীবনের যাত্রা আবার নতুন দেশের নতুন আকাশতলে শুরু হইবার দিন ঘনাইয়া আসিতেছে।
পুরাতন দিনের সঙ্গে যে-সব জায়গার সম্পর্ক—আর একবার সে-সব দিকে ঘুবিয়া ঘুরিয়া বেড়াইল…
মায়ের মৃত্যুর পূর্বে যে ছোট একতলা ঘরটাতে থাকিত অভয় নিয়োগী লেনের মধ্যে—সেটার পাশ দিয়াও গেল। বহুকাল এইদিকে আসে নাই।
গলির মুখে একটা গ্যাসপোস্টের কাছে সে চুপ করিয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল
একটি ছিপছিপে চেহারার উনিশ কুড়ি বছরের পাড়াগাঁয়ের যুবক সামনের ফুটপাতে হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে—কিছু মুখচোরা, কিছু নির্বোধ বোধ হয় নতুন কলিকাতায় আসিয়াছে—বোধহয় পেট ভরিয়া খাইতে পায় নাইক্ষুধাশীৰ্ণ মুখ—অপু ওকে চেনে—ওর নাম অপূর্ব রায়।-তেরো বছর আগে ও এই গলিটার মধ্যে একতলা বাড়িটাতে থাকিত। এক মুঠো হোটেলের রান্না ভাতডালের জন্য হোটেলওয়ালার কত মুখনাড়া সহ্য করিত–মায়ের সঙ্গে দেখা করিবার প্রত্যাশায় পাঁচিলের গায়ে দাগ কাটিয়া ছুটির আর কতদিন বাকি হিসাব রাখিত। দাগগুলি জামরুল গাছটার পাশে লোনাধরা পাঁচিলের গায়ে আজও হয়তো আছে।
সন্ধ্যার অন্ধকারে গ্যাস জ্বলিয়া উঠার সঙ্গে সঙ্গে যুবকের ছবি মিলাইয়া গেল…
বাসার নির্জন ছাদে একা আসিয়া বসিল। মনে কি অদ্ভুত ভাব!—কি অদ্ভুত অনুভূতি নবমীর জ্যোৎস্না উঠিয়াছে—কেমন সব কথা মনে উঠে—বিচিত্র সব কথা-বসিয়া বসিয়া জবে, এই রকম জ্যোৎস্না আজ উঠিয়াছে তাদের মনসাপোতার বাড়িতে, নাগপুরের বনে তার সেই খড়ের বাংলোর সামনের মাঠে, বাল্যে সেই একটিবার গিয়াছিল লক্ষ্মণ মহাজনের বাড়ি, তাদের উঠানের পাশে সেই পুকুর পাড়টাতে, নিশ্চিন্দিপুরের পোডড়া-ভিটাতে, অপর্ণা ও সে শ্বশুরবাড়ির যে ঘরটাতে শুইতোয়ই জানলার গায়ে-চাঁপদানিতে পটেশ্বরীদের বাড়ির উঠানে–দেওয়ানপুরের বোর্ডিংয়ের কম্পাউন্ডে, জীবনের সহিত জড়ানো এই সব স্থানের কথা ভাবিতেই জীবনের বিচিত্ৰতা, প্রগাঢ় রহস্য তাহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিল…
এবার কলিকাতা হইতে বাড়ি ফিরিবার সময় মাঝেরপাড়া স্টেশনে নামিয়া অপু আর হাঁটিয়া বাড়ি যাইতে পারিল না-খোকাকে আজ দেড়মাস দেখে নাই—ছক্রোশ বাস্তা পায়ে হাঁটিয়া বাড়ি পৌঁছিতে সন্ধ্যা হইয়া যাইবে—খোকার জন্য মন এত অধীর হইয়া উঠিয়াছে যে, এত দেরি করা একেবারেই অসম্ভব।-বাবার কথা মনে হইল—বাবাও ঠিক তাকে দেখিবার জন্য, দিদিকে দেখিবার জন্য এমনি ব্যস্ত হইয়া উঠিতেন—প্রবাস হইতে ফিবিবার পথে তাদের বাল্যে। আজকাল পিতৃহদয়ের এসব কাহিনী সে বুঝিয়াছে—কিন্তু তখন তো হাঁটিয়া যাওয়া ছাড়া পন্থা ছিল না, এখন আর সেদিন নাই, মোটরবাসে এক ঘন্টার মধ্যেই নিশ্চিন্দিপুর। যা একটু দেরি সে কেবল বেত্রবতীর খেয়াঘাটে।
গ্রামে পৌঁছিতে অপুর প্রায় বেলা তিনটা বাজিয়া গেল।
সন্ধ্যার কিছু পূর্বে মাদুর পাতিয়া রানুদিদের রোযাকে ছেলেকে লইয়া বসিল। লীলা আসিল, রানু আসিল, ও-বাড়ির রাজলক্ষ্মী আসিয়া বসিল। বানুদেব বাড়ির চারিধারে হেমন্ত অপরাহু ঘনাইয়াছে—নানা লতাপাতার সুগন্ধ উঠিতেছে…
কি অদ্ভুত ধরনের সোনালি রোদ এই হেমন্ত বৈকালেব! আকাশ ঘন নীল—তার তলে বানুদিদের বাড়ির পিছনে বাঁশের ঝাড়ে সোনালি সড়কির মতো বাঁশের সূচালো ডগায় রাঙা রোদ মাখানো, কোনটার উপর ফিঙে পাখি বসিয়া আছে–বাদুড়ের দল বাসায় ফিরিতেছে!…পাঁচিলের পাশের বনে এক একটা আমড়া গাছে থোলো থোলো কাঁচা আমড়া।
সন্ধ্যার শাঁখ বাজিল। জগতের কি অপূর্ব রূপ!…আবার অপুর মনে হয়, এদের পেছনে কোথায় আর একটা অসাধারণ জগৎ আছে—ওই বাঁশবনের মাথার উপরকার সিঁদুরে মেঘভরা আকাশ, বাঁশের সোনালি সড়কির আগায় বসা ফিঙে পাখির দুলুনি—সেই অপূর্ব, অচিন্ত্য জগৎটার সীমানায় মনকে লইযা গিয়া ফেলে। সন্ধ্যার শখ কি তাদের পোডভিটাতেও বাজিল?. পূজার সময় বাবাব খরচপত্র আসিত না, মা কত কষ্ট পাইত-দিদির চিকিৎসা হয় নাই।সে সব কথা মনে আসিল কেন এখন?
অন্য সবাই উঠিয়া যায়। কাজল পড়িবার বই বাহির কবে। রানু বান্নাঘরে রাঁধে, কুটনো কোটে। অপুকে বলে—এইখানে আয় বসবি, পিড়ি পেতে দি
অপু বলে, তোমার কাছে বেশ থাকি বানুদি। গাঁয়ের ছেলেদেব কথাবার্তা ভালো লাগে না।
রানু বলে—দুটি মুড়ি মেখে দি—খা বসে বসে। দুধটা জ্বাল দিয়েই চা করে দিচ্ছি।
–রানুদি সেই ছেলেবেলাকার ঘটিটা তোমাদের–না?
রানু বলে—আমার ঠাকুরমা জগন্নাথ থেকে এনেছিলেন তার ছেলেবয়সে। আচ্ছা অপু, দুগগার মুখ তোর মনে পড়ে?
অপু হাসিয়া বলেনা রানুদি। একটু যেন আবছায়া—তাও সত্যি কিনা বুঝিনে।
রানু দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিল—আহা! সব স্বপ্ন হয়ে গেল।
অপু ভাবে, আজ যদি সে মারা যায়, খোকাও বোধ হয় তাহার মুখ এমনি ভুলিয়া যাইবে।