ফিরিয়া আসিবার সময় শুনিল, আগন্তুক ভদ্রলোকটি বলিতেছেন, আনইউজুয়াল ফর এ বয় অব ফোর্থ ক্লাস। কি নাম বললেন? এ স্ট্রাইকিংলি হ্যান্ডসাম বয়-বেশ বেশ!
অপু পরে জানিয়াছিল তিনি স্কুল-বিভাগের বড়ো ইন্সপেক্টর, না বলিয়া হঠাৎ স্কুল দেখিতে আসিয়াছিলেন।
পরে সে রমাপতির ঘরে আঁক বুঝিতে যায়। রমাপতি অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে, নিজের সীট বেশ সাজাইয়া রাখিয়াছে। টেবিলের উপর পাথরের দোয়াতদানি, নতুন নিব পরানো কলমগুলি সাফ করিয়া গুছাইয়া রাখিয়াছে, বিছানাটি ধবধবে, বালিশের ওপর তোয়ালে। অপুর সঙ্গে পড়াশুনার কথাবার্তা মিটিবার পর সে বলিল, এবার তোমায় সরস্বতী পুজোতে ছোট ছেলেদের লীডার হতে হবে, আর তো বেশি দেরিও নেই, এখন থেকেই চাঁদা আদায়ের কাজে বেবুনো চাই।
উঠিবার সময় ভাবিল, রমাপতিদার মতো এইরকম একটা দোয়াতদানি হয় আমার? চমৎকার ফুলকটা? লিখে আরাম আছে। হ্যাঁ, চাদ চাইতে যাব বইকি! ওসব হবে না। আমায় দিয়ে।–আসল কথা সে বেজায় মুখচোরা, কাহারও সহিত কথা বলিতে পরিবে না।
সে নিজের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, দেবব্রত সমীরের টেবিলে মাথা রাখিয়া চুপ করিয়া শুইয়া আছে। অপু বলিল, কি দেবু, বাড়ি যাও নি আজ?
দেবব্রত মাথা না তুলিয়াই বলিল, দেখুন না কাণ্ড সেকেন মাস্টারের, ছুটি দিলে না-ও শনিবারে বাড়ি যাই নি, আপনি তো জানেন অপুর্বদা! বললে, তুমি ফি শনিবারে বাড়ি যাও, তোমার ছুটি হবে না।–
দেবব্রতর জন্য অপুর মনে বড়ো কষ্ট হইল। বাড়ির জন্য তাহার মনটা সারা সপ্তাহ ধরিয়া কি রকম তৃষিত থাকে অপু সে সন্ধান রাখে। মনে ভাবিল, ওরই ওপর সুপারিন্টেন্ডেন্টের যত কড়াকড়ি। থাকতে পারে না, ছেলেমানুষ-আচ্ছা লোক!
অপু বলিল, রমাপতিদাকে দিয়ে আমি একবার বিধুবাবুকে বলবো?
দেবব্রত মান হাসিয়া বলিল, কাকে বলবেন? তিনি আছেন বুঝি? মেয়ের জন্যে নিধে বোহারাকে দিয়ে বাজার থেকে কমললেবু আনলেন, কপি আনালেন। তিনি বাড়ি চলে গিয়েছেন কোন কালে, সে দুটোর ট্রেনে-আর এখন বলেই বা কি হবে, আমাদের লাইনের গাড়িও তো চলে গিয়েছে-আজ আর গাড়ি নেই।
অপু তাহাকে ভুলাইবার জন্য বলিল, এসো একটা খেলা করা যাক। তুমি হও চোর, একখানা বই চুরি করে লুকিয়ে থাকে, আমি ডিটেকটিভ হবো, তোমাকে ঠিক খুঁজে বার করবো-কিংবা ওইটে যেন একটা নকশা, তুমি ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে পালাবে, আমি তোমাকে খুঁজে বার করব—-পড়ো নি ‘নিহিলিস্ট রহস্য’? চমৎকার বই-উঃ, কি সে কাণ্ড? প্রতুলের কাছে আছে, চেয়ে দেবো।
দেবব্রতের খেলাধুলা ভালো লাগিতেছিল না, তবুও অপুর কথার কোন প্রতিবাদ না করিয়া মাথা তুলিয়া বসিল। বলিল, আমি লাইব্রেরির ওই কোণটায় গিয়ে লুকিয়ে থাকিব?
-লুকিয়ে থাকতে হবে না, এই কাগজখানা একটা দরকারি নকশা, তুমি পকেটের মধ্যে নিয়ে যেন রেলগাড়িতে যাচ্চো, আমি বার করে দেখে নেবো, তুমি পিস্তল বার করে গুলি করতে আসবে—
দেবব্রতকে লইয়া খেলা জমিল না, একে সে ‘নিহিলিস্ট রহস্য’ পড়ে নাই, তাহার উপর তাহার মন খারাপ। নূতন ধরনের যুদ্ধ-জাহাজের নকশাখানা সে বিনা বাধায় ও এত সহজে বিপক্ষের গুপ্তচরকে চুরি করিতে দিল যে, তাহাকে এসব কার্যে নিযুক্ত করিলে রুশীয় সম্রাটকে পতনের অপেক্ষায় ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিদ্রোহের মুখ চাহিয়া বসিয়া থাকিতে হইত না।
বেলা প্ৰায় পড়িয়া আসিয়াছে। বোর্ডিং-এর পিছনে দেওয়ানি আদালতের কম্পাউন্ডে অর্থীপ্রত্যার্থীর ভিড় কমিয়া গিয়াছে। দেবব্রত জানালার দিকে চাহিয়া বলিল, ক্লক টাওয়ারের ঘড়িতে কটা বেজেছে দেখুন না একবার? কাউকে বলবেন না অপূর্বদা, আমি এখুনি বাড়ি যাব।
অপু বিস্ময়ের সুরে বলিল, এখন যাবে কিসে? এই যে বললে ট্রেন নেই?
দেবব্রত সুর নিচু করিয়া বলিল-এগার মাইল তো রাস্তা মোটে, হেঁটে যাব, একটু রাত যদি হয়ে পড়ে জ্যোৎস্না আছে, বেশ যাওয়া যাবে।
-এগারো মাইল রাস্তা এখন এই পড়ন্ত বেলায় হেঁটে যেতে কত রাত হবে জানো? রাস্তা কখনও হেঁটেচো তুমি? তা ছাড়া না বলে যাওয়া-যদি কেউ টের পায়?
কিন্তু দেবব্রতকে নিবৃত্ত করা গেল না। সে কখনও রাস্তা হ্যাঁটে নাই তাহা ঠিক, রাত্রি হইবে তাহা ঠিক, বিধুবাবুর কানে কথাটা উঠিলে বিপদ আছে, সবই ঠিক কিন্তু বাড়ি সে যাইবেই-সে কিছুতেই থাকিতে পরিবে না-যাহ ঘটে ঘটবে। অবশেষে অপু বলিল, তা হলে আমিও তোমার সঙ্গে যাই।
দেবব্রত বলিল, তা হলে সবাই টের পেয়ে যাবে, আপনি তিন-চার মাস বোর্ডিং ছেড়ে কোথাও যান নি, খাবার-ঘরে না দেখতে পেলে সবাই জানতে পারবে।
দেবব্রত চলিয়া গেলে অপু কাহারও নিকট সে কথা বলিল না বটে, কিন্তু পরদিন সকালে খাওয়ার ঘরে দেখা গেল দেবব্রতের অনুপস্থিতি অনেকে লক্ষ করিয়াছে। রবিবার বৈকালে সমীর আসিলে তাহাকে সে কথাটা বলিল। পরদিন সোমবার দেবব্রত সকলের সম্মুখে কি করিয়া বোর্ডিংএর কম্পাউন্ডে ঢুকিবে বা ধরা পড়িলে কৃতকর্যের কি কৈফিয়ত দিবে। এই লইয়াই দুজনে অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা করিল।
কিন্তু সকালে উঠিয়া দেবব্রতাকে সমীরের বিছানায় শুইয়া ঘুমাইতে দেখিয়া সে দস্তুর মতো অবাক হইয়া গেল। সমীর বাইরে মুখ ধুইতে গিয়াছিল, আসিলে জানা গেল যে, কাল অনেক রাত্রে দেবব্ৰত আসিয়া জানালায় শব্দ করিতে থাকে। পাছে কেউ টের পায় এজন্য পিছনের জানালাব খোলা-গরাদটা তুলিয়া সমীর তাহাকে ঘরে ঢুকাইয়া লইয়াছে।