কিছুতেই আমাদের দেশের লোকে বিস্মিত হয় না কেন বলতে পারো, প্রণব? বিস্মিত হবার ক্ষমতা একটা বড়ো ক্ষমতা। যে মানুষ কোনও কিছু দেখে বিস্মিত হয় না, মুগ্ধ হয় না, সে তো প্রাণহীন। কলকাতায় দেখেছি কি তুচ্ছ জিনিস নিযেই সেখানকার বড়ো বড়ো লোকে দিন কাটায়। জীবনকে যাপন করা একটা আর্ট—তা এরা জানে না বলেই অল্প বয়সে আমাদের দেশে জীবনের ব্যবসায়ে দেউলে হয়ে পড়ে।
দিনের মধ্যে খানিকটা অন্তত নির্জনে বসে থেকে ভাবতে হয়—উঃ, সে দেখেছিলুম নাগপুরে ভাইসে কী অবর্ণনীয় আনন্দ পেতুম। বৈকালটিতে যখন কোনো শালবনের ছায়ায় পাথরের ওপর গিয়ে বসতুম—লোকাতীত যে বড়ো জীবন শত শত জন্মমৃত্যুর দূর পারে অক্ষুন, তার অস্তিকে মন যেন চিনে নিত…ডি সিটারের, আইনস্টাইনের বিশ্বটার চেয়েও তা বড়ো।
এখানে এসেও তাই মনে হচ্ছে প্রণব।…এখানে বুঝেছি জগতে কত সামান্য জিনিস থেকে কৃত গভীর আনন্দ আসতে পারে। তুচ্ছ টাকা, তুচ্ছ যশ-মান। আমার জীবনে এরাই হোক অক্ষয়। এত ছায়া, এত ভঁসা খেজুরের আতাফুলের সুগন্ধ, এত স্মৃতির আনন্দ কোথায় আর পাব? হাজার বছর কাটিয়ে দিতে পারি এখানে, তবু এ পুরোনো হবে না যেন।
লীলাকে জানতে? আমার মুখে দু-একবার শুনেছ। সে আর নেই। সে সব অনেক কথা। কিন্তু যখনই তার কথা ভাবি, অপর্ণার কথা ভাবি, তখন মনে হয় এদের দুজনের সঙ্গ পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়ে গিয়েছে বাইবেলে পড়েছ তোAnd। saw a new Heaven and a new Earth এরা জীবন দিয়ে আমার সে চোখ খুলে দিয়েছে।
হ্যাঁ, তোমায় লিখি। আমি বাইরে যাচ্ছি। খুব সম্ভব যাব ফিজি ও সামোয়া—এক বন্ধুর কাছ থেকে ভরসা পেয়েছি। কাজলকে কোথা রেখে যাই এই ছিল সমস্যা। তোমার মামার বাড়ি রাখব না-তোমার মেজমামিমা লিখেছেন কাজলের জন্যে তাদের মন খারাপ, সে চলে গিয়ে বাড়ি অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। তোক অন্ধকার, সেখানে আর নয়। আমার এক বাল্যসঙ্গিনী এখানে আছেন। তার কাছেই ওকে রেখে যাব। এঁর সন্ধান না পেলে বিদেশে যাওয়া কখনও ঘটে উঠত না, খোকাকে যেখানে-সেখানে ফেলে যেতে পারতুম না তো!
আজ আবার এয়োদশী তিথি, মেঘশূন্য আকাশ সুনীল। খুব জ্যোৎস্না উঠবে—ইচ্ছা হয় তোমায় নিয়ে দেখাই এ-সব, তোমার ঋণ শোধ দিতে পাব না জীবনে ভাই—তুমিই অপর্ণাকে জুটিয়ে দিয়েছিলে—কত বড়ো দান যে সে জীবনের, তা তুমিও হয়তো বুঝবে না।
তোমারই চিরদিনের বন্ধু
অপূর্ব
২৬. অবোধ বালক অপু
ষড়বিৎশ পরিচ্ছেদ
দুপুরে একদিন রানু বলিল, অপু, তোর কিছু দেনা আছে–
–কি দেনা রানুদি?
–মনে আছে আমার খাতায় একটা গল্প শেষ করিস নি?
রানু একটা খাতা বাহির কব্যি আনিল। অপু খাতাটা চিনিতে পারিল না। বানু বলিল—এতে একটা গল্প আধখানা লিখেছিলি মনে আছে ছেলেবেলায়? শেষ লিখে দে এবার।.অপু অবাক হইয়া গেল। বলিল—রানুদি, সেই খাতাখানা এতকাল বেখে দিয়েছ তুমি?
রানু মৃদু মৃদু হাসিল।
–কেশ দাও! এখন আমার লেখা কাগজে বেবুচ্ছে, তোমার খাতাখানায় গল্পটা অর্ধেক রাখব। কিন্তু কি ভেবে খাতাখানা রেখেছিলে রানুদি এতদিন?
–শুনবি? একদিন তোর সঙ্গে দেখা হবেই, গল্প শেষ করে দিবিই জানতুম।
অপু মনে ভাবিল—তোমাদের মতো বাল্যসঙ্গিনী জন্ম জন্ম যেন পাই বানুদি। মুখে বলিলসত্যি? দেখি—দেখি খাতাটা।
খাতা খুলিয়া বাল্যের হাতের লেখাটা দেখিয়া কৌতুক বোধ করিল। রানীকে দেখাইয়া হাসিয়া বলিল—একটা পাতে সাতটা বানান ভুল করে বসে আছি দ্যাখো।
সে এই মঙ্গলরূপিণী নারীকেই সারাজীবন দেখিয়া আসিয়াছে—এই স্নেহময়ী, করুণাময়ী নারীকে—হয়তো ইহা সম্ভব হইয়াছে এই জন্য যে, নারীর সঙ্গে তার পরিচয় অল্পকালেব ও ভাসা ভাসা ধরনের বলিয়া—অপর্ণা দু-দিনের জন্য তার ঘর করিয়াছিল লীলাব সহিত যে পরিচয় তাহা সংসারের শত সুখ ও দুঃখ ও সদাজাগ্রত স্বার্থদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়া নহে—পটেশ্বরী, রানুদি, নির্মলা, নিরুদি, তেওয়ারী-বধু-সবাই তাই। তাই যদি হয় অপু দুঃখিত নয়—তাই ভালো, এই স্রোতের শ্যাওলার মতো ভাসিয়া বেড়ানো ভবঘুরে পথিক-জীবনে সহচরসহচরীগণের যে কল্যাণপাণি ক্ষুধার সময় তাহাকে অমৃত পরিবেশন করিয়াছে—তাহাতেই সে ধন্য, আরও বেশি মেশামিশি করিয়া তাহাদের দুর্বলতাকে আবিষ্কার করিবার শখ তাহার নাই—সে যাহা পাইয়াছে, চিরকাল সে নারীর নিকট কৃতজ্ঞ হইয়া থাকিবে ইহার জন্য।
ভাদ্রের শেষে আর একবার কলকাতায় আসিয়া খবরের কাগজে একদিন পড়িল, ফিজিপ্রত্যাগত কয়েকজন ভারতীয় আর্যমিশনে আসিয়া উঠিয়াছেন। তখনই সে আৰ্যমিশনে গেল। নিচে কেহ নাই, জিজ্ঞাসা করিলে একজন উপরের তলায় যাইতে বলিল।
ত্রিশ-বত্রিশ বৎসরের একজন যুবক হিন্দিতে তাহার আগমনের উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করিল। অপু বলিল—আপনারা এসেছেন শুনে দেখা করতে এলুম। ফিজির সব খবর বলবেন দয়া করে? আমার খুব ইচ্ছে সেখানে যেতে।
যুবকটি একজন আর্যসমাজী মিশনারি। সে ইস্ট আফ্রিকা, ট্রিনিদাদ, মরিশস—নানা স্থানে প্রচারকার্য করিয়াছে। অপুকে ঠিকানা দিল, পোস্ট বক্স ১১৭৫, লউটোকা, ফিজি। বলিল, অযোধ্যা জেলায় আমার বাড়ি—এবার যখন ফিজি যাব একসঙ্গেই যাব।
অপু যখন আমিশন হইতে বাহির হইল, বেলা তখন সাড়ে দশটা।
বাসায় আসিয়া টিকিতে পারিল না। কাজল সেখানে নাই, ঘরটার সর্বত্র কাজলের স্মৃতি, ওই জানালাতে কাজল দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া রাস্তার লোক দেখিত-দেওয়ালের ওই পেরেকটা সে-ই পুঁতিয়াছিল, একটা টিনের ভেঁপু ঝুলাইয়া বাখিত-ওই কোণটাতে টুলটার উপব বসিয়া পা দুলাইয়া দুলাইয়া মুড়ি খাইত-অপুর যেন হাঁপ ধরে—ঘরটাতে সত্যই থাকা যায় না।