তাহা ছাড়া বাল্যের সুপরিচিত ও অতি প্রিয় সাথীদের অনেকে বাঁচিয়া নাই। বোষ্টম দাদু নাই, জ্যাঠাইমা-রানুদির মা নাই, আশালতাদি বিবাহের পর মরিয়া গিয়াছে, পটু এদেশ হইতে উঠিয়া গিয়া অন্য কোথায় বাস করিতেছে, নেড়া, রাজু রায়, প্রসন্ন গুরুমশায় কেহই আর নাই—স্বামী মারা যাওয়ার পরে গোকুলের বউ খুড়িমাকে ঠাহার ভাই আসিয়া লইয়া গিয়াছে-দশ বারো বৎসর তিনি এখানে আসেন নাই, বাঁচিয়া আছেন কিনা কেহ জানে না।
তবু মেয়েদের ভালো লাগে। রানুদি, ও-বাড়ির খুড়িমা, রাজলক্ষ্মী, লীলাদি, এরা স্নেহে, প্রেমে, দুঃখে, শোকে যেন অনেক বাড়িয়াছে, এতকাল পরে অপুকে পাইয়া ইহারা সকলেই খুশি, কথায় কাজে এদের ব্যবহার মধুর ও অকপট। পুরাতন দিনের কথা ওদের সহিত কহিয়া সুখ আছেবহুকালের খুটিনাটি কথাও মনে রহিয়াছে—হয়তো বা জীবনের পরিধি ইহাদের সংকীর্ণ বলিয়াই, ক্ষুদ্র বলিয়াই এতটুকু তুচ্ছ জিনিসও আঁকড়াইয়া রাখিয়াছে।
আজ সে একথা বুঝিয়াছে, জীবনে অনবরত বিরুদ্ধ অবস্থার সঙ্গে লড়াই করিয়া চলিতে হইয়াছিল বলিয়াই আজ সে যাহা পাইয়াছে—এখানে পৈতৃক জমিজমার মালিক হইয়া নির্ভাবনায় বসিয়া থাকিলে তাহা পাইত না। আজ যদি সে বিদেশে যায়, সমুদ্রপারে যায়—যে চোখ লইয়া সে যাইবে, নিশ্চিন্দিপুরে গত পঁচিশ বৎসর নিষ্ক্রিয় জীবন-যাপন করিলে সে চোখ খুলিত না। একদিন নিশ্চিন্দিপুরকে যেমন সে সুখ-দুঃখ দ্বারা অর্জন করিয়াছিল—আজ তেমনি সুখ-দুঃখ দিয়া বাহিরকে অর্জন করিয়াছে।
নদীতে গা ধুইতে গিয়া নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় এইসব কথাই সে ভাবিতেছিল। সারাদিনটা আজ গুমট গরম, প্রতিপদ তিথি-কাল গিয়াছে পূর্ণিমা। আজ এখনই জ্যোৎস্না উঠিবে।
এই নদীতে ছেলেবেলায় যে-সব বধূ জল লইতে আসিত, তারা এখন প্রৌঢ়, কত নাইও–মরিয়া হাজিয়া গিয়াছে, যে-সব কোকিল সেই ছেলেবেলাকার রামনবমী দিনের পুলকমুহূর্তগুলি ভরাইয়া দুপুরে কু কু ডাক দিত, কচিপাতা-ওঠা বাঁশবনে তাদের ছেলেমেয়েরা আবার তেমনি গায়।
শুধু তাহার দিদি শুইয়া আছে। রায়পাড়ার ঘাটের ওধারে ওই প্রাচীন ছাতিম গাছটার তলায় তাহাদের গ্রামের শ্মশান, সেখানে। সে-দিদির বয়স আর বাড়ে নাই, মুখের তারুণ্য বিলুপ্ত হয় নাই তার কাচের চুড়ি, নাটাফলের পুটুলি অক্ষয় হইয়া আছে এখনও। প্রাণের গোপন অন্তরে যেখানে অপুর শৈশবকালের কাঁচা শিশুমনটি প্রবৃদ্ধ জীবনের শত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, উচ্চাশা ও কম্যুপের নিচে চাপা পড়িয়া মরিয়া আছে—সেখানে সে চিরবালিকা, শৈশব জীবনের সে সমাধিতে জনহীন অন্ধকার রাত্রে সেই আসিয়া নীরবে চোখের জল ফেলে—শিশু প্রাণের সাথীকে আবার খুঁজিয়া ফেরে।
আজ চব্বিশ বৎসর ধবিয়া সাঁঝ সকালে তার আশ্রয়স্থানটিতে সোনার সূর্যকিরণ পড়ে। বর্ষাকালের নিশীথ মেঘ ঝর ঝর জল ঢালে, ফান দিনে ঘেঁটুফুল, হেমন্ত দিনে ছাতিমফুল ফোটে। জ্যোৎস্না উঠে। কত পাখি গান গায়। সে এ সবই ভালোবাসিত। এ সব ছাড়িয়া যাইতে পারে নাই কোথাও।
» ২৫. জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে সে একবার কলিকাতা আসিলফিরিতে কুড়ি পঁচিশ দিন দেরি হইয়া গেল— আষাঢ় মাসের শেষ, বর্ষা ইতিমধ্যে খুব পড়িয়াছিল, সম্প্রতি দু-একদিন একটু ধরিল, কখনও আকাশ। মেঘাচ্ছন্ন, দিন ঠাণ্ডা, কোনদিন বা সারাদিন খররৌদ্র।
এই কদিনে দেশের চেহারা বদলাইয়াছে, গাছপালা আরও ঘন সবুজ, উঁচু গাছের মাথা হইতে কচি মাকাললতা লম্বা হইয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে-বাল্যের অতীব পরিচিত দৃশ্য, এখনও বউ-কথা-কও ডাকে, কিন্তু কোকিল ও পাপিয়া আর নাই—এখনও বনে সোঁদালি ফুলের ঝাড় অজস্র, কচি পটপটি ফলের থোলো বাঁধিয়াছে গাছে গাছে কটু গন্ধ ঘেটকোল বোজ বেলাশেষে কোন্ ঝোপঝাপের অন্ধকারে ফোটে, ঘাটের পথে ফিরিবার সময় মেয়েরা নাকে কাপড় চাপা দেয়—কি পবিচিত, কি অপূর্ব ধরনের পরিচিত সবই, অথচ বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছিল সবটা এতদিন। বাহিরের মাঠ সবুজ হইয়াছে নবীন আউশ ধানে—এই সময় একদিন সে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে আর একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করিল।
খুব রৌদ্র, দুপুর ঘুরিয়া গিয়াছে, বেলা তিনটার কম নয়, অপু কি কাজে গ্রামের পিছনদিকের বনের পথ ধরিয়া যাইতেছিল। দুধারে বর্ষার বনঝোপ ঘন সবুজ, বাঁশবনে একটা কঞ্চি হইতে হলদে পাখি উড়িয়া আর একটা কঞ্চিতে বসিতেছে।
একটা জায়গায় ঘন বনের মধ্যে সুঁড়ি পথ, বড়োগাছের পাতার ফাঁক দিয়া ঝলমলে পরিপূর্ণ রৌদ্র পড়িয়া কচি, সবুজ পাতার রাশি স্বচ্ছ দেখাইতেছে, কেমন একটা অপূর্ব সুগন্ধ উঠিতেছে। বনঝোপ হইতেসে হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া গেল সেদিকে চাহিয়াই। তাহার সেই অপূর্ব শৈশব জগৎটা!
ঠিক এইরকম সুঁড়ি বনের পথ বাহিয়া এমনি রৌদ্রালোকিত ঘুঘুডাকা দীর্ঘ শ্রাবণ দিনে দুপুর ঘুরিয়া বৈকাল আসিবার পূর্ব সময়টিতে সে ও দিদি কৌশালিকের বাসা, পাকা মাকালফল মিষ্টি রাংচিতার ফল খুঁজিয়া বেড়াইত-দুপুর রোদের গন্ধমাখানো, কত লতা দোলানো, সেই রহস্যভরা, করুণ, মধুর আনন্দলোকটি!…মাইল বাহিয়া এ গতি নয়, সেখানে যাওয়ার যানবাহন নাই—পৃথিবীর কোথায় যেন একটি পথ আছে যাহা সময়ের বীথিতল বাহিয়া মানুষকে লইয়া চলে তার অলক্ষিতে। ঘন ঝোপের ভিতর উকি মারিতেই চক্ষের নিমেষে তাহার ছাব্বিশ বৎসর পূর্বের শৈশবলোকটিতে আবার সে ফিরিয়া গেল, যখন এই বন, এই নীল আকাশ, উজ্জ্বল আনন্দভরা এই রৌদ্রমাখানো শ্রাবণ দুপুরটাই ছিল জগতের সবটুকু-বাহিরের বিশ্বটা ছিল অজানা, সে সম্বন্ধে কিছু জানিতও না, ভাবিতও না…রঙে রঙে রঙিন রহস্যঘন সেই তার প্রাচীন দিনের জগৎটা…