খিড়কিদোরের পাশে উঁচু জমিটাতে মায়ের হাতে পোতা সজনে গাছ এখনও আছে। যাইবার বছরখানেক আগে মাত্র মা ডালটা পুঁতিয়াছিল—এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে গাছটা বাড়িয়া বুড়া হইয়া গিয়াছে-ফল খাইতে আর কেহ আসে না—জঙ্গলে ঢাকিয়া পড়িয়া আছে এতকাল–অপরাহের রাঙা বোদ গাছটার গায়ে পড়িয়া কি উদাম, বিষাদ-মাখা দৃশ্যটা ফুটাইয়াছে যে…ছায়া ঘন হইয়া আসে, কাঁচাকলায়ের ডালের মতো সেই লতাটার গন্ধ আরও ঘন হয়—অপুর শরীর যেন শিহরিয়া ওঠে—এ গন্ধ তো শুধু গন্ধ নয়—এই অপরাহু, এই গন্ধের সঙ্গে জড়ানো আছে মায়ের কত রাত্রের আদরের ডাক, দিদির কত কথা, বাবার পদাবলী গানের সুর, বাল্যের ঘরকন্নার সুধাময় দারিদ্র্য–কত কি—কত কি–
ঘন বনে ঘুঘু ডাকে, ঘুঘু—ঘু–
সে অবাক চোখে রাঙাবোদ মাখানো সজনে গাছটার দিকে আবার চায়-মনে হয় এ বন, এ স্তুপাকার ইটের রাশি, এ সব স্বপ্ন—এখনই মা ঘাট হইতে সন্ধ্যায় গা ধুইয়া ফিরিয়া ফরসা কাপড় পরিয়া ভিজা কাপড়খানা উঠানের বাঁশের আলনায় মেলিয়া দিবে, তারপরে প্রদীপ হাতে সন্ধ্যা দিতে দিতে তাহাকে দেখিয়া থমকাইয়া দাঁড়াইয়া বিস্মিত অনুযোগের সুরে বলিয়া উঠিবে—এত সন্ধে করে বাড়ি ফিরলি অপু?
ভিটার চারিদিকে খোলামকুচি, ভাঙা কলসী; কত কি ছড়ানো-ঠাকুরমায়ের পোডোভিটাতে তো পা রাখিবার স্থান নাই, বৃষ্টির বোয়াটে কতদিনের ভাঙা খারা, খোলামকুচি বাহির হইয়াছে। এগুলি অপুকে বড়ো মুগ্ধ করিল, সে হাতে করিয়া তুলিয়া দেখিতে লাগিল। কতদিনের গৃহস্থ জীবনের সুখ দুঃখ এগুলার সঙ্গে জড়ানো! মা পিছনের বাঁশবনে এক জায়গায় সংসারের হাঁড়িকুড়ি ফেলিত, সেগুলি এখনও সেইখানেই আছে। একটা আস্কে-পিঠে গড়িবার মাটির মুচি এখনও অভগ্ন অবস্থায় আছে। অপু অবাক হইয়া ভাবে, কোন্ আনন্দভরা শৈশব সন্ধ্যার সঙ্গে ওর সম্বন্ধ ছিল না জানি! উঠানের মাটির খোলামকুচির মধ্যে সবুজ কাচের চুড়ির টুকরা পাওয়া গেল। হয়তো তার দিদির হাতের চুড়ির টুকরা।—এ ধরনের চুড়ি ছোট মেয়েরাই পরে—টুকরাটা সে হাতে তুলিয়া লইল। এক জায়গায় আধখানা বোতল ভাঙা-ছেলেবেলায় এ ধরনের বোতলে মা নারিকেল তৈল রাখিত—হয়তো সেটাই।
একটা দৃশ্য তাকে বড়ো মুগ্ধ করিল। তাদের রান্নাঘরের ভিটার ঠিক যে কোণে মা রাধিবার হাঁড়িকুড়ি রাখিত-সেখানে একখানা কড়া এখনও বসানো আছে, মরিচা ধবিয়া বিকৃত হইয়া গিয়াছে, আংটা খসিয়া গিয়াছে, কিন্তু মাটিতে বসিয়া যাওয়ার দরুন একটুও নড়ে নাই।
তাহারা যেদিন রান্না খাওয়া সাবিয়া এ গাঁ ছাড়িয়া রওনা হইয়াছিল—আজ চব্বিশ বৎসর পূর্বে, মা এঁটো কড়াখানাকে ওখানেই বসাইয়া রাখিয়া চলিয়া গিয়াছিল—কে কোথায় লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু ওখানা ঠিক আছে এখনও।
কত কথা মনে ওঠে। একজন মানুষের অন্তরতম অন্তবের কাহিনী কি অন্য মানুষ বোঝে। বাহিরের মানুষের কাছে একটা জঙ্গলে ভরা পোডোভিটা মাত্ৰ-মশার ডিপো। তুচ্ছ জিনিস। কে বুঝিবে চব্বিশ বৎসর পূর্বের এক দরিদ্র ঘরের অবোধ বালকের জীবনের আনন্দ-মুহূর্তগুলির সহিত এ জায়গার কত যোগ ছিল?
ত্রিশ, পঞ্চাশ, একশা, হাজার, তিন হাজার বছর কাটিয়া যাইবে—তখন এ গ্রাম লুপ্ত হইবে, ইচ্ছামতই চলিয়া যাইবে, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সভ্যতা, নতুন ধরনের রাজনৈতিক অবস্থা—যাদের বিষয় এখন কল্পনা করিতেও কেহ সাহস করে না, তখন আসিবে জগতে! ইংরেজ জাতির কথা প্রাচীন ইতিহাসের বিষয়ীভূত হইয়া দাঁড়াইবে, বর্তমান বাংলা ভাষাকে তখন হয়তো আর কেহ বুঝিবে না, একেবারে লুপ্ত হইয়া গিয়া সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ভাষা এদেশে প্রচলিত হইবে।
তখনও এই রকম বৈকাল, এই রকম কালবৈশাখী নামিবে তিন হাজার বর্ষ পরের বৈশাখ দিনের শেষে! তখনও এই রকম পাখি ডাকিবে, এই রকম চাঁদ উঠিবে। তখন কি কেহ জাবিবে তিনহাজার বছর পূর্বের এক বিস্মৃত বৈশাখী বৈকালের এক গ্রাম্যবালকের ক্ষুদ্র জগৎট এই রকম বৃষ্টির গন্ধে, ঝোড়ো হাওয়ায় কি অপূর্ব আনন্দে দুলিয়া উঠিত—এই স্নিগ্ধ অপরাহু তার মনে কি আনন্দ, আশা-আকাক্ষা জাগাইয়া তুলিত? তিন হাজার বছরের প্রাচীন জ্যোস্না একদিন কোন মায়াবগ্ন তাহার শৈশবমনে ফুটাইয়া তুসিয়াছিল? নিঃশব্দে শরৎ দুপুরে বনপথে ক্রীড়ারত সে ক্ষুদ্র নয় বৎসরের বালকের মনের বিচিত্র অনুভূতিরাজির ইতিস কোথায় লেখা থাকিবে? কোথায় লেখা থাকিবে, বিস্মৃত অতীতে তার সে সব আনন্দভরা জীবনযাত্রা, বিদেশ হইতে বহুদিন পরে বাড়ি ফিরিয়া মায়ের হাতে বেলের শরবৎ খাওয়ার সে মধুময় চৈত্র অপরাছুটি, বাঁশ বনের ছায়ায় অপরাহের নিদ্রা ভাঙিয়া পাপিয়ার সে মনমাতানো ডাক, কোথায় লেখা থাকিবে বর্ষাদিনের বৃষ্টিসিক্ত রাত্রিগুলির সে সব আনন্দকাহিনী।
দুর ভবিষ্যতের যেসব তরুণ বালকবালিকার মনে এই সব কালবৈশাখী নব আনন্দের বার্তা আনিবে, কোন্ পথে তারা আসিবে?
বাহির হইয়া আবার সে ফিরিয়া চাহিল।
সারা ভিটার উপর আসন্ন সন্ধ্যা এক অদ্ভুত, করুণামাখা ছায়া ফেলিয়াছে, মনে হয়, বাড়িটার এই অপূর্ব বৈকাল কাহার জন্য বহুকাল অপেক্ষা করিয়া ক্লান্ত জীর্ণ, অবসন্ন ও অনাসক্ত হইয়া পড়িয়াছে—আর সাড়া দেয় না, প্রাণ আর নাই।
বার বার করিয়া ঘুলঘুলিটার কথা মনে পড়িতেছিল। ঘুলঘুলি দুটা এত ভালো আছে এখনও, অথচ মানুষেরাই গেল চলিয়া!
সে নিশ্চিন্দিপুরও আর নাই। এখন যদি সে এখানে আবার বাসও করে সে অপূর্ব আনন্দ আর পাইবে না—এখন সে তুলনা করিতে শিখিয়াছে, সমালোচনা করিতে শিখিয়াছে, ছেলেবেলায় যারা ছিল সাথী—এখন তাদের সঙ্গে আর অপুর কোনদিকেই মিশ খায় না তাদের সঙ্গে কথা কহিয়া আর সে সুখ নাই, তারা লেখাপড়া শিখে নাই, এই পঁচিশ বৎসরে গ্রাম ছাড়িয়া অনেকেই কোথাও যায় নাই—সবারই পৈতৃক কিছু জমি-জমা আছে, তাহাই হইয়াছে তাদের কাল। তাদের মন, তাদের দৃষ্টি পঁচিশ বৎসর পূর্বের সেই বাল্যকালের কোঠায় আজও নিশ্চল।…কোন দিক হইতেই অপুর আর কোন যোগ নাই তাহাদের সহিত। বাল্যে কিন্তু এসব দৃষ্টি খোলে নাই-—সব জিনিসের উপর একটা অপরিসীম নির্ভরতার ভাব ছিল—সব অবস্থাকেই মানিয়া লইত বিনা বিচারে। সত্যকার জীবন তখনই যাপন করিয়াছিল নিশ্চিন্দিপুরে।