সে পাখির দল মরিয়া গিয়াছে, তেমন দুপুর আর হয় না; যে চাঁদ এমন বৈশাখী রাত্রে খড়ের ঘরের দাওয়ার ধারের নারিকেল পত্রশাখায় জ্যোৎস্নার কম্পন আনিয়া এক ক্ষুদ্র কল্পনাপ্রবণ গ্রাম্য বালকের মনে মূলহীন, কারণহীন আনন্দের বান ডাকাইত, সে সব চাদ নিভিয়া গিয়াছে। সেই বালকটিই বা কোথায়? পঁচিশ বৎসব আগেকার এক দুপুরে বাপ-মায়ের সঙ্গে দেশ ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিল, আর ফেরে নাই, জাওয়া-বাঁশের বনের পথে তার ছোট ছোট পায়ের দাগ অস্পষ্ট হইয়া মুছিয়া গিয়াছে বহুদিন।
তার ও তার দিদির সে সব আশা পূর্ণ হইয়াছিল কি?
হায় অবোধ বালক-বালিকা!…
বোজ বোজ বৈকালে মেঘ হয়, ঝড় ওঠে। অপু বলে, রানুদি, আম কুড়িয়ে আনি? রানী হাসে। অপু ছেলেকে লইয়া নতুন কেনা বাগানে আসিয়া দাঁড়ায়–সবাইকে আম কুড়াইতে ডাকে, কাহাকেও বাধা দেয় না। বাল্যের সেই পটুলে, তেঁতুলতলী, নেকো, বাঁশতলা,—ঘন মেঘের ছায়ায় জেলেপাড়ার তো আবালবৃদ্ধবনিতা ধামা হাতে আম কুড়াইতে আসে। অপু ভাবে, আহা, জীবনে এই এদের কত আনন্দেব কত সার্থকতার জিনিস। চারিধারে চাহিয়া দেখে, সমস্ত বাগানের তলাটা ধাবমান, কৌতুকপর, চিৎকার-রত বালক-বালিকাতে ভরিয়া গিয়াছে!
দিদি দুর্গা, ছোট্ট মেয়েটি, এই কাজলের চেয়ে কিছু বড়ো, পরের বাগানে আম কুড়াইবার অপরাধে বকুনি খাওয়া কৃত্রিম উল্লাসভরা হাসিমুখে একদিন এই ফণিমনসার ঝোপের পাশের বেড়াটা গলিয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল—বহুকালের কথাটা।
অপু কি করিবে আমবাগানে? এই সব গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা সাধ মিটাইয়া আম কুড়াইবে এ বাগানে, কেহ তাহাদের বারণ করিবার থাকিবে না, বকিবার থাকিবে না, অপমান করিবার থাকিবে না, ফণিমনসার ঝোপের আড়ালে অপমানিত ছোট্ট খুকিটি ধুলামাখা আঁচল গুছাইয়া লইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া মৃদু মৃদু তৃপ্তির হাসি হাসিবে…
এত দিন এখানে আসিলেও নিজেদের ভিটাটাতে ঢুকিতে পারে নাই, যদিও বাহির শুতে সেটা প্রতিদিনই দেখিত; কারণ ঘাটের পথটা তার পাশ দিয়াই। বৈকালের দিকে সে একদিন এক চুপি চুপি বনজঙ্গল ঠেলিয়া সেখানে ঢুকিল। বাড়িটা আর নাই, পড়িয়া ইট সুপাকার হইয়া আছে—সতাপাতা, শ্যাওড়ান, বনচালতার গাছ, ছেলেবেলাকার মতো কালমেঘের জঙ্গল। পিছনের বাঁশঝাড়গুলা এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাড়িয়া চারিধারে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে।
কোনও ঘরের চিহ্ন নাই, বনজঙ্গল, রাঙা রোদ বাঁশের মগডালে। পশ্চিমের পাচিলের গায়ে সেই কুলুঙ্গিটা আজও আছে, ছেলেবেলায় যে কুলুঙ্গিটাতে সে ভাটা, বাতাবিলেবুর বল, কড়ি রাখিত। এত নিচু কুলুঙ্গিটা তখন কত উঁচু বলিয়া মনে হইত, তাহার মাথা ছাড়াইয়া উঁচু ছিল, ডিঙাইয়া দাঁড়াইলে তবে নাগাল পাওয়া যাইত! ঠেস-দেওয়ালের গায়ে ছুরি দিয়া ছেলেবেলায় একটা ভূত আঁকিয়াছিল, সেটা এখনও আছে। পাশেই নীলমণি জ্যাঠামশায়ের পোডভিটা—সেও ঘন বনে ভরা, চারিধার নিঃশব্দ, নির্জন—এ পাড়াটাই জনহীন হইয়া গিয়াছে, এধার দিয়া লোকজনের যাতায়াত বড়ো কম। এই সে স্থানটি, কতকাল আগে যেখানে দিদি ও সে একদিন চড়ুইভাতি করিয়াছিল! কণ্টকাকীর্ণ শেয়াকুল বনে দুর্গম দুর্ভেদ্য হইয়া পড়িয়াছে সারা জায়গাটা। পোড়োভিটার সে বেলগাছটা—একদিন যার তলায় ভীষ্মদেব শরশয্যা পাতিতেন তাহার নয় বৎসরের শৈশবে সেটা এখনও আছে, পুষ্পিত শাখা-প্রশাখার অপূর্ব সুবাসে অপরাহ্ণে বাতাস মিন্ধ করিয়া তুলিয়াছে।
পাঁচিলের ঘুলঘুলিটা কত নিচু বলিয়া মনে হইতেছে, এইটাতেই অপু আশ্চর্য হইল—বার বার কথাটা তার মনে হইতেছিল। কত ছোট ছিল সে তখন! খোকার মতো অতটুকু বোধ হয়।
কাঁচাকলায়ের ডালের মতো সেই কি লতার গন্ধ বাহির হইতেছে!…কতদিন গন্ধটা মনে ছিল, বিদেশে আর সব কথা হয়তো মনে পড়িতে পারে, কিন্তু পুরাতন দিনের গন্ধগুলা তো মনে পড়ে না–
এ অভিজ্ঞতাটা অপুর এতদিন ছিল না। সেদিন বাঁওড়ের ধারে বেড়াইতে গিয়া পাকা বটফলের গন্ধে অনেকদিনের একটা স্মৃতি মনে উদয় হইয়াছিল—ছোট্ট কাচের পরকলা বসানো মোমবাতির সেকেলে লণ্ঠন হাতে তাহার বাবা শশী যোগীর দোকানে আলকাতবা কিনিতে আসিয়াছে—সেও আসিয়াছে বাবাব কাঁধে চড়িয়া বাবার সঙ্গে—কাচের লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো, আধঅন্ধকার বাঁশবন, বাঁওড় হইতে নাল ফুল তুলিয়া বাবা তাহার হাতে দিয়াছে—কোন্ শৈশবের অস্পষ্ট ছবিটা, অবাস্তব, ধোঁয়া-ধোঁযা! পাকা বটফলের গন্ধে কতকাল পরে তাহার সেই অত্যন্ত শৈশবের একটা সন্ধ্যা আবার ফিরিয়া আসিয়াছিল সেদিন।
পোড়াভিটার সীমানায় প্রকাণ্ড একটা খেজুর গাছে কাঁদি কাঁদি ডাঁসা খেজুর ঝুলিতেছে—এটা সেই চারা খেজুর গাছটা, দিদি যার ডাল কাটারি দিয়া কাটিয়া গোড়ার দিকে দড়ি বাঁধিয়া খেলাঘবের গরু করিত—কত বড়ো ও উঁচু হইয়া গিযাছে গাছটা!
এইখানে খিড়কিদোরটা ছিল, চিহ্নও নাই কোনও! এইখানে দাঁড়াইয়া দিদির চুরি-করা সেই সোনার কৌটাটা ঘুড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছিল একদিন। কত সুপরিচিত জিনিস এই দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর আজও আছে! রাঙী গাইয়ের বিচালি খাওয়ার মাটির নাদাটা কাটালতলায় বাঁশপাতা ও মাটি বোঝাই হইয়া এখনও পড়িয়া আছে। ছেলেবেলায় ঠেস দেওয়াল গাঁথার জন্য বাবা মজুর দিয়া এক জায়গায় ইট জড়ো করিয়া রাখিয়াছিলেন…অর্থাভাবে গাঁথা হয় নাই। ইটগুলা এখনও বাঁশবনের ছায়ায় তেমনি পড়িয়া আছে। কতকাল আগে মা তাকের উপর জলদানে পাওয়া মেটে কলসী তুলিয়া রাখিয়াছিল, সংসারের প্রয়োজনের জন্য–পড়িয়া মাটিতে অর্ধপ্রোথিত হইয়া আছে। সকলের অপেক্ষা সে যেন অবাক হইয়া গেল…পাঁচিলের সেই ঘুলগুলিটা আজও নতুন অবিকৃত অবস্থায় দেখিয়া-বালিচুন একটুও খসে নাই, যেন কালকের তৈরি-এই জঙ্গল ও ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কি হইবে ও কুলুঙ্গিতে?