দুপুরে একদিন খাইতে বসিয়া অপু চুপ করিয়া চোখ বুজিয়া বসিয়া আছে। রানীর দিকে চাহিয়া চাহিয়া হাসিয়া বলিল—একটা বড়ো চমৎকার ব্যাপার হল—দেখো, এই টকে-যাওয়া এঁচড়-চচ্চড়ি কতকাল খাই নি নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে আর কখনও নয়—তাই মুখে দিয়েই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল রানুদি—
রানুদি বোঝে এসব কথা—তাই রানুদির কাছে বলিয়াও সুখ।
এ কয়দিন আকাশটা ছিল মেঘ-মেঘ। কিন্তু হঠাৎ কখন মেঘ কাটিয়া গিয়াছে সে জানে না বৈকালে ঘুম ভাঙিয়া উঠিয়া সে অবাক চোখে চুপ করিয়া বাহিরের রোয়াকে বসিয়া রহিল+বাল্যের সেই অপূর্ব বৈকাল—যাহার জন্য প্রথম প্রথম বিরহী বালক-মন কত হইয়াছে বিদেশ, ক্রমে একটা অস্পষ্ট মধুর স্মৃতিমাত্র মনে আঁকিয়া রাখিয়া যেটা কবে মন হইতে বেমালুম অন্ততি হইয়া গিয়াছিল—
মনে পড়ে, ছেলেবেলায় এই সব সময়ে ঘুম ভাঙিয়া তাহার মনটা কেমন অকারণে খারাপ হইত এক একদিন এমন কান্না আসিত, বিছানায় বসিয়া ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিত—তাহার মা ঘাট হইতে আসিয়া বলিত-ও-ওই উড়ে গেল—ও-ও ওই।…কেঁদো না থোকা, বাইরে এসে পাখি দেখসে। আহা-হা তোমার বড়ো দুখখু খোকন—তোমার নাতি মরেছে, পুতি মরেছে, সাত ডিঙে ধন সমুদুরে ডুবে গিয়েছে, তোমার বড় দুখখু—কেঁদো না, কেঁদো না, আহা হা!…
রানী পাতকুয়া হইতে জল তুলিয়া আনিতে যাইতেছে, অপু বলিল—মনে পড়ে রানুদি, এই উঠানে এমন সব বিকেলে বৌ-চুরি খেলা খেলতুম কত, তুমি, আমি, দিদি, সতু, নেড়া?
রানী বলিল—আহা, তাই বুঝি ভাবচিস বসে বসে! কত মালা গাঁথম মনে আছে বকুলতলায়? সারাদিন বকুলতলাতেই পড়ে আছি, আমি, দুগগা—আজকাল ছেলেমেয়েরা আর মালা গাঁথে না, বকুল ফুলও আর তেমন পড়ে থাকে না কালে কালে সবই যাচ্চে।
কিছু পরে জল লইয়া ফিরিবার সময়ে বলিল—এক কাজ কর না কেন অপু, সতু তো তোদের নীলমণি জ্যাঠার দরুন জমাটা ছেড়ে দেবে, তুই কেন গিয়ে বাগানটা নিগে যা না? তোদেরই তো ছিল—ও যা, নিজের জমি-জমাই বিক্রি করে ফেললে সব, তা আবার জমার বাগান রাখবে—নিবি তুই?
অপু বলিল,-মায়ের বড় ইচ্ছে ছিল, রানুদি। মরবার কিছুদিন আগেও বলত বড়ো হলে বাগানখানা নিস অপু। আমার আপত্তি নেই, যা দাম হবে আমি দেব।
প্রতি সন্ধ্যায় সতুদের বোয়াকে মাদুর পাতা হয়, বানী, লীলা, অপু, ছেলেপিলেদের মজলিশ বসে। সতুও যোগ দেয়, তবে তামাকের দোকান বন্ধ কবিয়া আসিতে তাহার রাত হইয়া যায়। অপু বলে–আচ্ছা, আজকাল তোমরা ঘাটেব পথে যাড়াতলায় পিঠে দাও না রানুদি? কই সেই কঁড়াগাছটা তো নেই সেখানে? রানী বলে—সেটা মরে গিয়েছে—তার পাশেই একটা চারা, দেখিস নি সিঁদুব দেওয়া আছে?…নানা পুরানো কথা হয়। অপু জিজ্ঞাসা করে—ছেলেবেলায় একবার পঙ্গপালের দল এসেছিল, মনে আছে লীলাদি?, গ্রামে একটি বিধবা যখন নববধূরূপে এ গ্রামে প্রথম আসেন, অপু তখন ছেলেমানুষ। তিনিও সন্ধ্যার পবে এ বাড়িতে আসেন। অপু বলে—খুড়িমা, আপনি নতুন এসে কোথায় দুধে-আলতার পাথরে দাঁড়িয়েছিলেন মনে আছে আপনার?
বিধবাটি বললেন—সে সব কি আব এ জন্মের কথা, বাবা? সে-সব কি আর মনে আছে?
অপু বলে—আমি বলি শুনুন, আপনাদের দক্ষিণের উঠোনে যে নিচু গোয়ালঘরটা ছিল, তারই ঠিক সামনে।
বিধবা মেয়েটি আশ্চর্য হইয়া বলেন-ঠিক, ঠিক, এখন মনে পড়েছে, এত দিনের কথা তোমার মনে আছে বাবা!
তাদেরই বাড়ির আর এক বিবাহে কোথা হইতে তাঁদেব এক কুটুম্বিনী আসেন, খুব সুন্দরী এতকাল পর তার কথা উঠে। সবাই তাঁকে দেখিয়াছিল সে সময়, কিন্তু নামটা কাহারও মনে নাই এখন। অপু বলে-দাঁড়াও রানুদি, নাম বলছি—তার নাম সুবাসিনী।
সবাই আশ্চর্য হইয়া যায়। লীলা বলে—তোর তখন বয়েস আট কি নয়, তোর মনে আছে তার নাম?—ঠিক, সুবাসিনীই বটে। সবারই মনে পড়ে নামটা।
অপু মৃদু মৃদু হাসিমুখে বলে—আরও বলছি শোনো, ডুরে শাড়ি পরত, রাঙা জমির ওপর ডুরে দেওয়া-না?
বিধবা বধুটি বলেন, ধন্যি বাপু যা হোক, রাঙা ডুরে পরত ঠিকই, বয়েস ছিল বাইশ-তেইশ। তখন তোমার বয়েস বহুর আষ্টেক হবে। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগেকার কথা যে!
অপুর খুব মনে আছে, অত সুন্দরী মেয়ে তাদের গাঁয়ে আর আসে নাই ছেলেবেলায়। সে বলিল-রাঙা শাড়ি পরে আমাদের উঠোনের কাটালতলায় জল সইতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, ছবিটা দেখতে পাচ্ছি এখনও।
এখানকার বৈকালগুলি সত্যই অপূর্ব। এত জায়গায় তো সে বেড়াইল, মাসখানেক এখানে থাকিয়া মনে হইল এমন বৈকাল সে কোথাও দেখে নাই। বিশেষ করিয়া বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসের মেঘহীন এই বৈকালগুলিতে সূর্য যেদিন অন্ত যাইবার পথে মেঘাবৃত না হয়, শেষ রাঙা আলোটুকু পর্যন্ত বড়ো গাছের মগডালে, বাঁশঝাড়ের আগায় হালকা সিদুরের রং মাখাইয়া দেয়, সেদিনের বৈকাল। এমন বিশ্বফুলের অপূর্ব সুরভিমাননা, এমন পাখি-ডাকা উদাস বৈকাল—কোথায় এর তুলনা? এত বেলগাছও কি এদেশটায়, ঘাটে, পথে, এ-পাড়া, ও-পাড়া সর্বত্র বিষফুলের সুগন্ধ।
একদিন—জ্যৈষ্ঠের প্রথমটা, বৈকালে আকাশ অন্ধকার করিয়া ঈশান কোণ হইতে কালবৈশাখীর মেঘ উঠিল, তারপরেই খুব ঝড়, এ বছরের প্রথম কালবৈশাখী। অপু আকাশের দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিল—তাদের পোডভিটার বাঁশবনের মাথার উপরকার দৃশাটা কি সুপরিচিত। বাল্যে এই মাথাদুলানো বাঁশঝাড়ের উপরকারের নীলকৃষ্ণ মেঘসজ্জা মনে কেমন সব অনতিস্পষ্ট আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগাইত, কত কথা যেন বলিতে চাহিত, আজও সেই মেঘ, সেই বাঁশবন, সেই বৈকাল সবই আছে, কিন্তু সে অপূর্ব জগৎটা আর নাই। এখন যা আনন্দ সে শুধু স্মৃতির আনন্দ মাত্র। এবার নিশ্চিন্দিপুর ফিরিয়া অবধি সে ইহা লক্ষ করিতেছে—এই বন, এই দুপুর এই গভীর রাত্রে চৌকিদারের হাঁকুনি, লক্ষ্মীপেঁচার ডাকের সঙ্গে কি এক অপূর্ব স্বপ্নমাখানো ছিল, দিগন্তরেখার ওপারের এক রহস্যময় কল্পলোক তখন সদা-সর্বদা হাতছানি দিয়া আহ্বান কবিত—তাদের সন্ধান আর মেলে না।