কাজল বলিল-বাবার সঙ্গেই তো কাল এলাম। গাঙ্গুলীবাড়িতে এসে উঠলাম রাত্রে। বাবা ওদের বাইরের ঘরে বসে গল্প করছে, মেলা লোক দেখা করতে এসেছে কিনা তাই।…
রানী দুই হাতের তালুর মধ্যে কাজলের সুন্দর মুখখানা লইয়া আদরের সুরে বলিল—খোকন, খোকন, ঠিক বাবার মতো দেখতে-চোখ দুটি অবিকল! তোমার বাবাকে এ পাড়ায় ডেকে নিয়ে এসো খোকন। বলগে রানুপিসি ডাকছে।
সন্ধ্যার আগেই ছেলের হাত ধরিয়া অপু রানীদের বাড়ি ঢুকিয়া বলিল—কোথায় গেলে রানুদি, চিনতে পারো?…রানু ঘরের ভিতর হইতে ছুটিয়া আসিল, অবাক হইয়া খানিকক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া রহিল, বলিল—মনে করে যে এলি এতকাল পরে?—তা ও-পাড়ায় গিয়ে উঠলি কেন? গাঙ্গুলীরা আপনার লোক হল তোর?…পরে লীলাদির মতো সেও কাঁদিয়া ফেলিল।
কি অদ্ভুত পরিবর্তন! অপুও অবাক হইয়া দেখিতেছিল, চোদ্দ বছরের সে বালিকা রানুদি কোথায়! বিধবার বেশ, বাল্যের সে লাবণ্যের কোনও চিহ্ন না থাকিলেও রানী এখনও সুন্দরী। কিন্তু এ যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত, শৈশব-সঙ্গিনী রানুদির সঙ্গে ইহার মিল কোথায়?…এই সেই রানুদি।
সে কিন্তু সকলের অপেক্ষা আশ্চর্য হইল ইহাদের বাড়িটার পরিবর্তন দেখিয়া। ভুবন মুখুজ্যেরা ছিলেন অবস্থাপন্ন গৃহস্থ, হেলেবেলার সে আট-দশটা পোলা, প্রকাণ্ড চণ্ডীমণ্ডপ, গরুবাদুর, লোকজনের কিছু নাই। চণ্ডীমণ্ডপের ভিটা মাত্র পড়িয়া আছে, পশ্চিমের কোঠা ভাঙিয়া কাহারা ইট লইয়া গিয়াছে-বাড়িটার ভাঙা, ধ্বসা, ছন্নছাড়া চেহারা, এ কি অদ্ভুত পরিবর্তন?
রানী সজল চোখে বলিল–দেখছিস কি, কিছু নেই আর। মা বাবা মারা গেলেন, টুনু, খুড়িমা এঁরাও গেলেন, সতুর মা-ও মারা গেল, সতু মানুষ হল না তো, এতদিন বিষয় বেচে বেচে চালাচ্ছে। আমরাও–
অপু বলিল—হ্যাঁ, লীলাদির কাছে সব শুনলাম সেদিন কাশীতে–
–কাশীতে? দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছে তোর? কবে–কবে?…
পরে অপুর মুখে সব শুনিয়া সে ভারি খুশি হইল। দিদি আসিতেছে তাহা হইলে? কতকাল দেখা হয় নাই।
রানী বলিল—বৌ কোথায়? বাসায়—তোর কাছে?
অপু হাসিয়া বলিল—স্বর্গে।
—ও আমার কপাল! কতদিন? বিয়ে করিস নি আর?…
সেই দিনই আবার বৈকালে চড়ক। আর তেমন জাঁকজমক হয় না, চড়ক গাছ পুঁতিয়া কেহ ঘুরপাক খায় না। সে বালমন কোথায়, মেলা দেখার অধীর আনন্দে ছুটিয়া যাওয়া—সে মনটা আর নাই, কেবল সে-সব অর্থহীন আশা, উৎসাহ, অপূর্ব অনুভূতির স্মৃতিটা মাত্র আছে। এখন যেন সে দর্শক আর বিচারক মাত্র, চব্বিশ বৎসরে মনটা কেমন বদলাইয়া গিয়াছে, বাড়িছে—তাহারই একটি মাপকাঠি আজ খুঁজিয়া পাইয়া দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। চড়কতলায় পুরানো আমলের কত পরিচিত বন্ধু নাই, নিবারণ গোয়ালা লাঠি খেলিত, ক্ষেত্র কাপালি বহুরূপীর সাজ দিত, হাবান মাল বাঁশের বাঁশি বাজাইয়া বিক্রয় করিত, ইহারা কেহ আর নাই, কেবল পুরাতনের সঙ্গে একটা যোগ এখনও আছে। চিনিবাস বৈরাগী এখনও তেলেভাজা খাবারের দোকান করে।
আজ চব্বিশ বছর আগে এই চড়কের মেলার পরদিনই তারা গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছিলতারপর কত ঘটনা, কত দুঃখ বিপদ, কত নূতন বন্ধুবান্ধব সব, গোটা জীবনটাই কিন্তু কেমন করিয়া এত পরিবর্তনের মধ্য দিয়াও সেই দিনটির অনুভূতিগুলির স্মৃতি এত সজীব, টাটকা, তাজা অবস্থায় আজ আবার ফিরিয়া আসিল!
সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। চড়কের মেলা দেখিয়া হাসিমুখে ছেলেমেয়েরা ফিরিয়া যাইতেছে, কারও হাতে বাঁশের বাঁশি, কারও হাতে মাটির রং করা ছোবা পালকি। একদল গেল গাঙ্গুলীপাড়ার দিকে, একদল সোনাডাঙা মাঠের মাটির পথ বাহিয়া, ছাতিমবনের তলায় ধুলজুড়ি মাধবপুরের খেয়াঘাটে চব্বিশ বছর আগে যাহারা ছিল ছোট, এই রকম মেলা দেখিয়া ভেঁপু বাজাইতে বাজাইতে তেলেভাজা, জিবেগজা হাতে ফিরিয়া গিয়াছিল, তাহারা অনেকদিন বড়ো হইয়া নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ঢুকিয়া পড়িয়াছে—কেউ বা মারা গিয়াছে; আজ তাহাদের ছেলেমেয়েদের দল ঠিক আবার তাহাই করিতেছে, মনে মনে আজিকাল এই নিষ্পাপ দায়িত্বহীন জীবনকোরকগুলিকে সে আশীর্বাদ করিল।
বৈশাখের প্রথমেই লীলা তার দেওরের সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুরে আসিল। দুই বোনে অনেকদিন পরে দেখা, দুইজনে গলা জড়াইয়া কাঁদিতে বসিল। অপুকে লীলা বলিল—তোর মনে যে এত ছিল, তা তখন কি জানি? তোর কল্যাণেই বাপের ভিটে আবার দেখলুম, কখনও আশা ছিল না যে আবার দেখব।
শোকর জন্য কাশী হইতে একরাশ খেলনা ও খাবার আনিয়াছে, মহা খুশির সহিত গড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়া সকলের সঙ্গে দেখাশুনা করিল।
অপু বৈকালে ছেলেকে লইয়া নৌকায় খাবরাপোতার ঘাট পর্যন্ত বেড়াইতে গেল। তেঁতুলতলার ঘাটের পাশে দক্ষিণদেশের ঝিনুকতোলা বড়ো নৌকা বাঁধা ছিল, হাওয়ায় আলকাতরা ও গাবের রস মাখানো বড়ো ডিঙিগুলার শৈশবের সেই অতি পুরাতন বিস্মৃত গন্ধ…নদীর উত্তর পাড়ে ক্রমাগত নলন, ওকড়া ও বননবুডোর গাছ, ঢালু ঘাসের জমি জলের কিনারা ছুঁইয়া আছে, মাঝে মাঝে ঝিঙে পটলের ক্ষেতে উত্তরে মজুরেরা টোকা মাথায় নিড়ান দেয়, এক এক স্থানে নদীর জল ঘন কালো, নিথর, কলার পাটির মতো সমতল—যেন মনে হয়, নদী এখানে গহন, গভীর, অতলস্পর্শ,-ফুলে ভরা উলুখড়ের মাঠ, আকন্দবন, ভঁসা খেজুরের কাঁদি দুলানো খেজুর গাছ, উইটিবি, বকের দল, উঁচু শিমুল ডালে চিলের বাসা—সবাইপুরের মাঠের দিক হইতে বড়ো এক ঝাক শামকুট পাখি মধুখালির বিলের দিকে গেল–একটা বাবলাগাছে অজস্র বন-ধুধু ফল দুলিতে দেখিয়া থোকা আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল–ওই দেখো বাবা, সেই যে কলকাতায় আমাদের গলির মোড়ে বিক্রি হয় গায়ে সাবান মাখবার জন্যে, কত ঝুলছে দেখো, ও কি ফল বাবা?