ট্রেনে উঠিয়াও যেন অপুর বিশ্বাস হইতেছিল না, সে সত্যই নিশ্চিন্দিপুরের মাটিতে আবার পা দিতে পারিবে নিশ্চিন্দিপুর, সে তো শৈশবের স্বপ্নলোক! সে তো মুছিয়া গিয়াছে, মিলাইয়া গিয়াছে, সে শুধু একটা অনতিস্পষ্ট সুখস্মৃতি মাত্র, কখনও ছিল না, নাইও।
মাঝেরপাড়া স্টেশনে ট্রেন আসিল বেলা একটার সময়। খোক লাফ দিয়া নামিল, কারণ প্ল্যাটফর্ম খুব নিচু। অনেক পরিবর্তন হইয়াছে স্টেশনটার, প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে জাহাজের মাস্তুলের মতো উঁচু যে সিগন্যালটা ছেলেবেলায় তাহাকে তাক লাগাইয়া দিয়াছিল সেটা আর এখন নাই। স্টেশনের বাইরে পথের উপর একটা বড়ো জাম গাছ, অপুর মনে আছে, এটা আগে ছিল না। ওই সেই বড়ো মাদার গাছটা, যেটার তলায় অনেককাল আগে তাহাদের এদেশ ছাড়িবার দিনটাতে মা খিচুড়ি রাঁধিয়াছিলেন। গাছের তলায় দুখানা মোটরবাস যাত্রীর প্রত্যাশায় দাঁড়াইয়া, অপুরা থাকিতে থাকিতে দুখানা পুরোেনো ফোর্ড ট্যাক্সিও আসিয়া জুটিল। আজকাল নাকি নবাবগঞ্জ পর্যন্ত বাস ও ট্যাক্সি হইয়াছে, জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল—জিনিসটা অপুর কেমন যেন ভালো লাগিল না। কাজল নবীন যুগের মানুষ, সাগ্রহে বলিল—মোটর কাটে করে যাব বাবা? অপু ছেলেকে জিনিসপত্রসমেত ট্যাক্সিতে উঠাইয়া দিল, বটের ঝুরি দোলানো, মিল্ক ছায়াভরা সেই প্রাচীন দিনের পথটা দিয়া সে নিজে মোটরে চড়িয়া যাইতে পারিবে না কখনই। এ দেশের সঙ্গে পেট্রোল গ্যাসের গন্ধ কি খাপ খায়?
চৈত্রমাসের শেষ। বাংলায় সত্যিকার বসন্ত এই সময়েই নামে। পথ চলিতে চলিতে পথের ধারে ফুলেভরা ঘেঁটুবনের সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ হইয়া গেল। এই কম্পমান চৈত্রদুপুরের রৌদ্রের সঙ্গে, আকন্দ ফুলের গন্ধের সঙ্গে শৈশব যেন মিশানো আছে—পশ্চিম বাংলার পল্লীতে এ কমনীয় বসন্তের রূপ সে তো ভুলিয়াই গিয়াছিল।
এই সেই বেত্রবতী! এমন মধুর স্বপ্নভরা নামটি কোন নদীর আছে পৃথিবীতে? খেয়া পার হইয়া আবার সেই আষাঢুর বাজার। ভিডোল ডানলপ টায়ারের বিজ্ঞাপনওয়ালা পেট্রোলের দোকান নদীর উপরেই। বাজারেরও চেহারা অনেক বদল হইয়া গিয়াছে। তেইশ বছর আগে এত কোঠা বাড়ি ছিল না। আষাঢ় হইতে হাঁটিয়া যাওয়া সহজ, মাত্র দু মাইল, জিনিসপত্রের জন্য একটা মুটে পাওয়া গেল, মোটরবাস ও ট্যাক্সির দরুন ভাড়াটিয়া গরুর গাড়ি আজকাল নাকি এদেশ হইতে উঠিয়া গিয়াছে। মুটে বলিল-ধঞ্চে-পলাশগাছির ওই কাঁচা রাস্তাটা দিয়ে যাবেন তো বাবু? ধঞ্চেপলাশগাছি?…নামটাই তো কতকাল শোনে নাই, এতদিন মনেও ছিল না, উঃ, কতকাল পরে এই অতি সুন্দর নামটা সে আবার শুনিতেছে!
বেলা পড়িয়া আসিয়াছে এমন সময়ে পথটা সোনাডাঙা মাঠের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল পাশেই মধুখালির বিল—পদ্মবনে ভরিয়া আছে। এই সেই অপূর্ব সৌন্দর্যভূমি, সোনাডাঙার স্বপ্নমাখানো মাঠটা মনে হইল এত জায়গায় তো বেড়াইল, এমন অপরূপ মাঠ ও বন কই কোথাও তো দেখে নাই! সেই বনবোপ, ঢিবি, বন, ফুলে ভর্তি বালা—বৈকালের এ কী অপূর্ব রূপ!
তারপরই দূর হইতে ঠাকুরঝি পুকুরের সেই ঠ্যাঙাড়ে বটগাছটার উঁচু ঝাকড়া মাথাটা নজরে পড়িল-যেন দিকসমুদ্রে ডুবিয়া আছে-ওর পরেই নিশ্চিন্দিপুর।–ক্রমে বটগাছটা পিছনে পড়িল–অপুর বুকের রক্ত চলাইয়া যেন মাথায় উঠিতে চাহিতেছে, সারা দেহ এক অপূর্ব অনুভূতিতে যেন অবশ হইয়া আসিতেছে। ক্রমে মাঠ শেষ হইল, ঘাটের পথের সেই আমবাগানগুলো-সে রুমাল কুড়াইবার ছলে পথের মাটি একটু তুলিয়া মাথায় ঠেকাইল। ছেলেকে বলিল-এই হল তোমার ঠাকুরদার গাঁ, খোকা, ঠাকুরদাদার নামটা মনে আছে তো-বলো তো বাবা
কি?
কাজল হাসিয়া বলিল—শ্রীহরিহর রায়, আহা, তা কি আর মনে আছে।
অপু বলিল, শ্রী নয় বাবা, ঈশ্বর বলতে হয়, শিখিয়ে দিলাম যে সেদিন?
বানুদির সঙ্গে দেখা হইল পরদিন বৈকালে।
সাক্ষাতের পূর্ব ইতিহাসটা কৌতুকপূর্ণ, কথাটা রানীর মুখেই শুনিল।
রানী অপু আসিবার কথা শুনে নাই, নদীর ঘাট হইতে বৈকালে ফিরিতেছে, বাঁশবনের পথে কাজল দাঁড়াইয়া আছে, সে একা গ্রামে বেড়াইতে বাহির হইয়াছে।
রানী প্রথমটা থতমত খাইয়া গেল—অনেককাল আগের একটা ছবি অস্পষ্ট মনে পড়িল— ছেলেবেলায় ওই ঘাটের ধারের জঙ্গলে-ভরা ভিটাটাতে হরিকাকারা বাস করিত, কোথায় যেন তাহারা উঠিয়া গিয়াছিল তারপরে। তাদের বাড়ির সেই অপু না?…ছেলেবেলার সেই অপু! পরক্ষণেই সামলাইয়া লইয়া সে কাছে গিয়া ছেলেটির মুখের দিকে চাহিল— অপুও বটে, নাও বটে। যে বয়সে সে গ্রাম ছাড়িয়া গিয়াছিল তার সে সময়ের চেহারাখানা রানীর মনে আঁকা আছে, কখনও ভুলিবে না—সেই বয়স, সেই চেহারা, অবিকল। রানী বলিল—তুমি কাদের বাড়ি এসেছ খোকা?
কাজল বলিল—গাঙ্গুলীদের বাড়ি
বানী ভাবিল, গাঙ্গুলীরা বড়োলোক, কলিকাতা হইতে কেহ কুটুম্ব আসিয়া থাকিবে, তাদেরই ছেলে। কিন্তু মানুষের মতো মানুষ হয়! বুকের ভিতরটা ছাঁৎ করিয়া উঠিয়াছিল একেবারে। গাঙ্গুলীবাড়ির বড়ো মেয়ের নাম করিয়া বলিল—তুমি বুঝি কাদুপিসির নাতি?
কাজল লাজুক চোখে চাহিয়া বলিল-কাদুপিসি কে জানি নে তো? আমার ঠাকুরদাদাব এই গাঁয়ে বাড়ি ছিল—তার নাম ঈশ্বর হরিহর রায়—আমার নাম অমিতাভ রায়।
বিস্ময়ে ও আনন্দে রানীর মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না অনেকক্ষণ। সঙ্গে সঙ্গে একটা অজানা ভয়ও হইল। বুদ্ধ নিঃশ্বাসে বলিল—তোমার বাবা-খোকা?…