সত্যিই বটে বেলা সাড়ে দশটা। রামধনবাবু পুরানো দিনের মতো ছাতি মাথায় লংক্লথেব ময়লা ও হাত-হেঁড়া পাঞ্জাবি গায়ে, ক্যাম্বিশের জুতা পায়ে দিয়া অপু দশ বৎসর পূর্বে যে অফিসটাতে কাজ করিত সেখানে গুটি গুটি চলিযাছেন।
অপু জিজ্ঞাসা করিল, রামধনবাবু, কতদিন কাজ হল ওদের ওখানে আপনার সবসুদ্ধ?
রামধনবাবু পুবানোনা দিনের মতো গর্বিত সুরে বলিলেন, এই সাঁইত্রিশ বছব যাচ্ছে। কেউ পারবে না বলে দিচ্ছি—এক কলমে এক সেরেস্তায়। আমার দ্যায় পাঁচ-পাঁচটা ম্যানেজার বদল হল–কত এল, কত গেল—আমি ঠিক বজায় আছি। এ শর্মার চাকরি ওখান থেকে কেউ নড়াতে পারছেন না—যিনিই আসুন। হাসিয়া বলিলেন,-এবার মাইনে বেড়েছে, পয়তাল্লিশ হল।
অপুর মাথা কেমন ঘুরিয়া উঠিল-সাঁইত্রিশ বছর একই অন্ধকার ঘরে এই হাতবাক্সের উপর ভারী খেরো-বাঁধানো রোকড়ের খাতা খুলিয়া কালি ও স্টীলপেনের সাহায্যে শীলেদের সংসারের চালডালের হিসাব লিখিয়া চলা—চারিধারে সেই একই দোকান-পসার, একই পরিচিত গলি, একই সহকর্মীর দল, একই কথা ও আলোচনা-বারো মাস, তিনশো তিরিশ দিন! সে ভাবিতে পারে না এই বদ্ধজল, পঙ্কিল, পচা পানা পুকুরের মতো গতিহীন, প্রাণহীন, ক্ষুদ্র জীবনের কথা ভাবিলেও তাহার গা কেমন করিয়া উঠে।
বেচারি রামধনবাবু-দরিদ্র, বৃদ্ধ, ওঁর দোষ নাই, তাও সে জানে। কলিকাতার বহু শিক্ষিত সমাজে, আচ্ছায়, ক্লাবে সে মিশিয়াছে। বৈচিত্রহীন একঘেয়ে জীবন-অর্থহীন, ছন্দহীন, ঘটনাহীন দিনগুলি। শুধু টাকা, টাকা—শুধু খাওয়া–পানাসক্তি, ব্রিজখেলা, ধূমপান, একই তুচ্ছ বিষয়ে একঘেয়ে অসার বকুনি—তরুণ মনের শক্তি নষ্ট করিয়া দেয়, আনন্দকে ধ্বংস করে, দৃষ্টিকে সংকীর্ণ করে, শেষে ঘোর কুয়াশা আসিয়া সূর্যালোককে রুদ্ধ করিয়া দেয়—ক্ষুদ্র, পঙ্কিল অকিঞ্চিৎকর জীবন কোনরকমে খাত বাহিয়া চলে। সে শক্তিহীন নয়—এই পরিণাম হইতে সে নিজেকে বাঁচাইবে।
তারপর সে রামধনবাবুর অনুরোধে কতকটা কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া শীলেদের বাড়ি গেল। সেই আপিস, ঘরদোর, লোকের দল বজায় আছে। প্রবোধ মুহুরি বড়োলোক হইবার জন্য কোন লটারিতে প্রতি বৎসর একখানি টিকিট কিনিতেন, বলিতেন—ও পাঁচটা টাকা বাজে খরচের সামিল ধরে রেখেছি দাদা। যদি একবার লেগে যায়, তবে সুদে আসলে সব উঠে আসবে।
তাহা আজও আসে নাই, কারণ তিনি আজও দেবোত্তর এস্টেটের হিসাব কষিতেছেন।
খুব আদর-অভ্যর্থনা করিল সকলে। মেজবাবু কাছে বসাইয়া জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। বেলা এগারোটা বাজে, তিনি এইমাত্র ঘুম হইতে উঠিয়াছেন—বিলিয়ার্ড ঘরের সামনের বারান্দাতে চাকর তাঁহাকে এখনই তৈল মাখাইবে, বড়ো রূপার গুড়গুড়িতে রেশমের গলাবন্ধওয়ালা নলে বেহারা তামাক দিয়া গেল।
এ বাড়ির একটি ছেলেকে অপু পূর্বে দিনকতক পড়াইয়াছিল, তখন সে ছোট ছিল, বেশ সুন্দর দেখিতে ছিলভারি পবিত্র মুখশ্রী, স্বভাবটিও ছিল ভারি মধুর। সে এখন আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে, কাছে আসিয়া পায়ের ধুলা লইয়া প্রণাম করিল–অপু দেখিয়া ব্যথিত হইল যে, সে এই সকালেই অন্তত দশটা পান খাইয়াছে—পান খাইয়া ঠোঁট কালো-হাতে রুপার পানের কৌটা-পান জর্দা। এবার টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়াছে, খানিকক্ষণ কেবল ফিল্মের গল্প করিল, বাস্টার কিটনকে মাস্টারমশায়ের কেমন লাগে?…চার্লি চ্যাপলিন? নৰ্মা শিয়ারারও সে অদ্ভুত!
ফিরিবার সময় অপুর মনটা বেদনায় পূর্ণ হইয়া গেল। বালক, ওর দোষ কি? এই আবহাওয়ার খুব বড়ো প্রতিভাও শুকাইয়া যায়-ও তো অসহায় বালক
রামধনবাবু বলিলেন, চললেন অপূর্ববাবু? নমস্কার। আসবেন মাঝে মাঝে।
গলির বাহিরে সেই পচা খড় বিচালি, পচা আপেলের খোলা, শুঁটকি মাছের গন্ধ।
রাত্রিতে অপুর মনে হইল সে একটা বড়ো অন্যায় করিতেছে, কাজলের প্রতি একটা গুরুতর অবিচার করিতেছে। ওরও তো সেই শৈশব। কাজলের এই অমূল্য শৈশবের দিনগুলিতে সে তাহাকে এই ইট, কংক্রিট, সিমেন্ট ও বার্ডকোম্পানির পেটেন্ট স্টোনে বাঁধানো কারাগারে আবদ্ধ রাখিয়া দিনের পর দিন তাহার কাঁচা, উৎসুক, স্বপ্নপ্রবণ শিশুমন তুচ্ছ বৈচিত্র্যহীন অনুভূতিতে ভরাইয়া তুলিতেছে—তাহার জীবনে বন-বনানী নাই, নদীর মর্মর নাই, পাখির কলস্বর, মাঠ, জ্যোৎস্না, সঙ্গীসাথীদের সুখদুঃখ—এসব কিছুই নাই, অথচ কাজল অতি সুন্দর ভাবপ্রবণ বালক—তাহার পরিচয় সে অনেকবার পাইয়াছে।
কাজল দুঃখ জানুক, জানিয়া মানুষ হউক। দুঃখ তার শৈশবে গল্পে পড়া সেই সোনা-করা জাদুকর! ছোঁড়া-খোঁড়া কাপড়, ঝুলি ঘাড়ে বেড়ায়, এই চাপদাড়ি, কোণে কাঁদাড়ে ফেরে, কারুর সঙ্গে কথা কয় না, কেউ পোঁছে না, সকলে পাগল বলে, দূর দূর করে, রাতদিন হাপর জ্বালায়; রাতদিন হাপর জ্বালায়।
পেতল থেকে, রাং থেকে, সীসে থেকে ও-লোক কিন্তু সোনা করিতে জানে, করিয়াও থাকে।
এই দিনটিতে বসিয়া ভাবিতে ভাবিতে সর্বপ্রথম এতকাল পরে একটা চিন্তা মনে উদয় হইল। নিশ্চিন্দিপুর একবারটি ফিরিলে কেমন হয়? সেখানে আর কেউ না থাক, শৈশব-সঙ্গিনী রানুদিদি তো আছে। সে যদি বিদেশে চলিয়া যায়, তার আগে খোকাকে তার পিতামহের ভিটাটা দেখাইয়া আনাও তো একটা কর্তব্য?
পরদিনই সে কাশীতে লীলাদিকে পঁচিশটা টাকা পাঠাইয়া লিখিল, সে খোকাকে লইয়া একবার নিশ্চিন্দিপুর যাইতেছে, খোকাকে পিতামহের গ্রামটা দেখাইয়া আনিবে। পত্রপাঠ যেন লীলাদি তার দেওরকে সঙ্গে লইয়া সোজা নিশ্চিন্দিপুর চলিয়া যায়।
২৪. ট্রেনে উঠিয়াও যেন অপুর বিশ্বাস হইতেছিল না
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ